বিডিআর হত্যাকাণ্ডের গভীরে ষড়যন্ত্র ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা

বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়। ঘটনাপ্রবাহের নৃশংসতা, সমন্বিত আক্রমণাত্মক আচরণ এবং পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া- সব মিলিয়ে এটি যে এক দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, তা বিভিন্ন সাক্ষ্য, জবানবন্দী ও ঘটনাপরম্পরা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

ঘটনার প্রাক-প্রস্তুতি, রাজনৈতিক বৈঠক, সাদা পতাকার ব্যবহার, রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা, সেনাবাহিনীকে আটকে রাখা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও নেতাদের আশ্বাসমূলক উপস্থিতি, সময়ক্ষেপণ এবং অকার্যকর তদন্ত—- সব মিলিয়ে প্রশ্ন জাগে : বিডিআর হত্যাকাণ্ড কি কেবল বিদ্রোহ ছিল, নাকি বৃহৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা? এসব তথ্য গুরুতর প্রশ্ন তোলে এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পুনঃতদন্তের দাবি পুনরুজ্জীবিত করে।

২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে ঘটে যাওয়া বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। বহুল আলোচিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়- ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়। ঘটনাপ্রবাহের নৃশংসতা, সমন্বিত আক্রমণাত্মক আচরণ এবং পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া- সব মিলিয়ে এটি যে এক দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, তা বিভিন্ন সাক্ষ্য, জবানবন্দী ও ঘটনাপরম্পরা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তি থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, নির্দিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিরা এবং বিডিআর-এর অভ্যন্তরীণ একটি অংশ- বহু স্তরে সমন্বিত যোগাযোগ ও কার্যকলাপ এই সন্দেহকে আরো জোরালো করে।

প্রতিবেদনে ঘটনাপরম্পরার প্রধান দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরে বলা হয়- এসব ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং এতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বহুস্তরের ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত মেলে।

ঘটনার পূর্বপর্ব : সন্দেহজনক বৈঠক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ : বিডিআর সদস্যদের সাথে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতার একাধিক বৈঠক- ঘটনার অন্তত কয়েক সপ্তাহ বা মাস আগে ঘটনাটিকে সুপরিকল্পিত বলেই ইঙ্গিত দেয়।

(১) ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেই ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের সাথে বিডিআর সদস্যদের মসজিদে সাক্ষাৎ ঘটে।

(২) মনোনয়নপত্র জমাদানের ঠিক আগের দিন তাপস দরবার হলের পাশে জনসভা করেন- বিডিআরের ওপর বক্তব্যের রেশ তখনো বিদ্যমান।

(৩) এর কিছুদিন পর লেদার লিটনের নেতৃত্বে ১০-১৫ জন বিডিআর সদস্য তাপসের চেম্বারে গোপন বৈঠক করেন।

(৪) ২০ জানুয়ারি ২০০৯ : ২০-২২ জন বিডিআর সদস্য শেখ সেলিমের বনানীর বাসায় সাক্ষাৎ করেন- যেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ নেয়ার আশ্বাস দেন।

২২-২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ সেলিম সিপাহি মইনকে জানান, ‘গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া গেছে’- যা পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের মাত্র তিন দিন আগে।

(৫) একই দিনে সোহেল তাজের নেতৃত্বে গোয়েন্দা সংস্থার একাংশ ও শেখ সেলিমপন্থীদের নিয়ে আরেকটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

(৬) হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে তাপসের অফিসে শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমসহ কয়েকজন নেতা হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন বলে বিভিন্ন জবানবন্দীতে উল্লেখ আসে।

প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভূমিকা ও রাষ্ট্রীয় নীরবতা এবং অস্বাভাবিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত : ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই পরিস্থিতি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্কটে রূপ নিলেও আশ্চর্যজনকভাবে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদ কোনো জরুরি সভা ডাকেননি। বরং প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং মির্জা আজমকে ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ অজুহাতে দায়িত্ব দেয়া হয়- যখন বাস্তব পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত সহিংস ও নিয়ন্ত্রণবিহীন।

রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের এমন নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক সমর্পণ কার্যত বিদ্রোহীদের জন্য সময় ও সুবিধা তৈরির ইঙ্গিতই দেয়।

সাদা পতাকা : কেন গুলি হলো না : ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর নানক ও মির্জা আজম সাদা পতাকা হাতে পিলখানায় প্রবেশ করেন, যা সাধারণত আত্মসমর্পণের প্রতীক।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- বিদ্রোহীরা তখনো সশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কেন তাদের ওপর একটি গুলিও চালালো না?

একই সময় অন্য দিক থেকে এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও মাহবুব আরা গিনিও সাদা পতাকা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। সাদা পতাকার এই সমন্বিত ব্যবহারকে বহু তদন্তকারী ‘পূর্বনির্ধারিত সঙ্কেত’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

লাশ দেখা, কিন্তু তথ্য গোপন : জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম ডিজির বাসভবনে ও দরবার হলে লাশ দেখেন; কিন্তু বাইরে এসে পুরো বিষয়টি চেপে যান।

এটি ছিল এমন এক সময় যখন তথ্য গোপন করলে তা সরাসরি হত্যাকারীদের পক্ষে সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

পূর্বপরিকল্পিত মিছিল : পালানোর পথ সুগম : নানককে তিন নম্বর গেটের কাছে দেখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই লেদার লিটনের নেতৃত্বে একাধিক মিছিল পিলখানায় প্রবেশ করে।

এই মিছিলগুলোর সাথে মিশে বহু হত্যাকারী পালিয়ে যায়। এটি একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাগম ছিল না; বরং সুস্পষ্টভাবে পরিকল্পিত ‘কভার’ অপারেশন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সক্রিয় উপস্থিতি ও উৎসাহমূলক বার্তা : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সিপাহি আইয়ুব আলীর জবানবন্দী অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুলেটপ্রুফ জিপে পুরো পিলখানা ঘুরে ঘুরে বিদ্রোহীদের আশ্বস্ত করছিলেন- ‘তোমরা আমার সন্তানের মতো, তোমাদের কিছু হবে না।’ ‘ডিএডি তৌহিদকে ডিজির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’

এমন বক্তব্য বিদ্রোহী বাহিনীকে কার্যত মানসিক সমর্থন দেয় এবং সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করে।

রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্ত : সেনাবাহিনীকে আটকে রাখা : ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার জবানবন্দী অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনীর প্রধানকে দীর্ঘ সময় তার কার্যালয়ে বসিয়ে রাখেন- যাতে সেনাবাহিনী দ্রুত কোনো অভিযান পরিচালনা করতে না পারে। যে সময়ে প্রতিটি মিনিট মূল্যবান ছিল, সেই সময়ে বাহিনীপ্রধানদের আটকে রাখা একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

২৬ ফেব্রুয়ারি : পরিকল্পিত বিলম্বে বিদ্রোহীদের পালানোর সুযোগ : ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে অভিযানের প্রস্তুতি শেষ হলেও, আওয়ামী লীগ নেতারা আম্বালা ইন-এ হত্যাকারীদের সাথে ‘আলোচনার’ নামে দীর্ঘ সময় নষ্ট করেন।

এ প্রহসনমূলক আলোচনার ফাঁকে অনেক হত্যাকারী আলামত ধ্বংস, লাশ গুম এবং পলায়নের সুযোগ পায়।

নাটকীয় অস্ত্রসমর্পণ : সরকারের সক্রিয় সহায়তা : ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কামরুল ইসলাম ও আইজিপি নূর মোহাম্মদ পিলখানায় প্রবেশ করে এক প্রহসনমূলক অস্ত্রসমর্পণের আয়োজন করেন। তবে তারা বেরিয়ে যেতেই হত্যাকারীরা আবার অস্ত্র তুলে নেয়। এই সময়েই ঘটে সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট ও আলামত ধ্বংসের ঘটনা।

তদন্ত কমিটিগুলোর সীমাবদ্ধতা- রাজনৈতিক চাপ : ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর কোনোটিকেই আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা বিশ্লেষণের সুযোগ দেয়া হয়নি।

মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) ও র‌্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ছিল প্রকট; তবুও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি; বরং অনেককে পুরস্কৃত করা হয়।

উপরের তথ্যগুলো গুরুতর প্রশ্ন তোলে এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পুনঃতদন্তের দাবি পুনরুজ্জীবিত করে।