পর্দার অন্তরালে রাজনৈতিক দলগুলো না বসলে ‘পলিটিক্যাল ডেডলক’ কাটবে না

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলেও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন।

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী
অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী |সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেছেন, রাজনৈতিকদলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনা আরো বাড়াতে হবে। আর নির্বাচনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক অনৈক্য দূর হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকবেই। প্রতিটি দেশেই অভ্যুত্থানের পর অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিকদলগুলো নিজেদের মধ্যে অনৈক্য দূর করতে পারলে এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ দূর হয়ে যাবে।

ডাকসু নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা বা এ নির্বাচনের আয়োজনের প্রস্তুতিকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ডাকসু নির্বাচন হলে ছাত্রদের মধ্যে একটা সৃষ্টিশীল চিন্তা আসবে, আর দেশেও একটা স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলেও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন। ২০২৩ সালের ৫ মে একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারকে কখনো নির্বাচনের মাধ্যমে সরানো যায় না। তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে সরাতে হয়। আর ঘরে বসে আন্দোলন হয় না।

ওই সাক্ষাৎকারে ড. নুরুল আমিন বেপারী আরো বলেছিলেন, শাসক দলকেই সংলাপের পথ খোলা রাখতে হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে দেশে একটা ম্যাসাকার হবে। যা রাষ্ট্র বা বিএনপির যতটা ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগের। সরকার ভুলে গেছে ২০১৮ সালের নির্বাচন রাতের আঁধারে হয়েছে।

পরিবর্তিত বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে সংলাপের পথ খোলা রাখার জন্যে আবারো তাগিদ দিয়েছেন অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী। তিনি বলেন, রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যেই সংলাপ হতে হবে, আলোচনার পথ খোলা রাখলে রাজনৈতিক অনৈক্য দূর হয়ে যাবে। নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

নয়া দিগন্ত : জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, কেউ বলছে স্থানীয় নির্বাচন আগে হোক, ডাকসু নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হতে যাচ্ছে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্যের অভাবে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

ড. নুরুল আমিন বেপারী : সব দেশেই গণ-অভুত্থ্যানের পর একটা রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশেও তেমনটি চলছে। তার মানে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে না তা নয়। রাজনৈতিকদলগুলোর নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করতে পারলে এ অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকবে না। তাই সংলাপের পথ খোলা রাখতে হবে। অতীতে কর্তৃত্ববাদী সরকার এ ধরনের সংলাপের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। এতে তাদেরই ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এখন সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সম্মতি বা বৈধ সরকার গঠন করতে হবে।

নয়া দিগন্ত : সংলাপের জন্য থিংকট্যাংকগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে এ ধরনের থিংকট্যাংকের বেশ অভাব। এজন্য অনেক সময় সক্রিয় ও কার্যকর আলোচনা হতে পারে না।

ড. নুরুল আমিন বেপারী : এখন সামনে হয় কি হয় না এবং কিভাবে হয় সেটার ওপর ভিত্তি করে সামগ্রিক দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকে নজর দিতে হবে। এই নজর দেয়ার জন্য আমি অতীতে বহুবার রাজনৈতিকদলগুলোর থিংকট্যাংকের প্রয়োজনের কথা বলেছি। এখনো বলছি। আমাদের দেশে কোনো দলই থিংকট্যাংক রাখে না। বুঝতে পারে না কখন কী হবে। কোনো দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে অনেক ইনস্টিটিউশনকে উন্নত করতে হয়। আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হলে দেশের রাজনৈতিকদলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এতে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর হয়ে রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি হয়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।

নয়া দিগন্ত : তার মানে নির্বাচনের মাধ্যমেই রাজনৈতিকদলগুলো নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাবও দূর করতে পারে?

ড. নুরুল আমিন বেপারী : অবশ্যই পারে। রাজনৈতিকদলগুলোকে আলোচনার মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। কিভাবে একটা ভালো নির্বাচন হবে সেটা রাজনৈতিকদলগুলোই এ ধরনের আলোচনার মধ্যে দিয়ে ঠিক করবে। প্রতিটি দেশেই অভ্যুত্থানের পর একটা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকে, থাকবেই। এখন রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ বা মতপার্থক্য যাই বলুন পর্দার অন্তরালে বসে হলেও একটা মীমাংসার পথে এগিয়ে যেতে হবে। কিভাবে তাদের সমস্যার সমাধান হয় সেভাবে তাদের দাবি-দাওয়া করতে হবে। রাজনৈতিকদলগুলো যদি আন্তরিকতার সাথে আলোচনায় বসতে পারে তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর যদি না হয়, এক দল পিছাইতে থাকে, বিএনপি যদি মনে করে এ সময়টা নির্বাচন দেন, অন্যরা যদি মনে করে না এ সময় না অন্য সময়ে নির্বাচন দেন বা সংগঠিত হয়ে নির্বাচনে যাব তাহলে তো আর মীমাংসা হবে না, পলিটিক্যাল ডেডলকটা থেকে যাবে।

নয়া দিগন্ত : তার মানে রাজনৈতিকদলগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সবকিছু?

ড. নুরুল আমিন বেপারী : অবশ্যই। রাজনৈতিকদলগুলো যদি আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে আমার মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব আগামী ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিল মাসে নির্বাচন দেবেন। খুব সম্ভবত নির্বাচন না দিলে উনি চলে যাবেন। উনি থাকবেন না এপ্রিলের পরে। আমার রাজনৈতিক বিশ্লেষণে তাই মনে হয়।

নয়া দিগন্ত : আপনার এমন কেন মনে হচ্ছে উনি চলে যাবেন?

ড. নুরুল আমিন বেপারী : উনি তো ওয়াদা দিয়েছেন যে এ সময়ের মধ্য নির্বাচন দেবেন। ফেব্রুয়ারিতে না হলে এপ্রিল। উনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। ইন্টারন্যাশনাল ফিগার। উনি ওনার ওয়াদাকে বরখেলাপ করতে চাবেন না। ওনার যে ইমেজটা, সেই ইমেজটা উনি নষ্ট করবেন আমার মনে হয় না।

সংলাপের বিষয়ে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, রাজনৈতিকদলগুলোকে আলোচনার দরজা খোলা রাখতে হবে। দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া যাবে না। অতীতের শাসক দল এটি নষ্ট করে দিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানের নিয়ম ভঙ্গ শুরু করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়। সংবিধান না মেনে, জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে তারা একক সিদ্ধান্তে দেশ চালিয়েছে এবং অকপটে মিথ্যা কথা বলে চরম বোকামি করেছে। পৃথিবীর সকল কর্তৃত্ববাদী সরকারই এসব ভুলে যায়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নুরুল আমিন বেপারী মনে করেন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। মনে রাখতে হবে নাগরিকের জন্য সংবিধান। সংবিধানের জন্য নাগরিক না। এ সঙ্কট সমাধান করতে হবে নাগরিক ও সার্বভৌমত্বের জন্য। কারণ অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে। দেশ না থাকলে রাজনীতি করব কী নিয়ে?

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশে এক ধরনের গার্বেজ তৈরি করেছে। ডিসি, এসপি, ওসি কেউ কারো কথা শুনেনি। মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্য কেউ কারো কথা শুনেনি। নির্বাচন কমিশনের কথা শুনেনি। এ প্রশাসন দিয়ে ভালো নির্বাচন করা যাবে না। এজন্য গার্বেজ পরিষ্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। তখন সুন্দর একটা নির্বাচন হবে। এখন প্রশ্ন, রাজনৈতিকদলগুলো কি তাদের থিংকট্যাংক নিয়ে চিন্তা করবে। তারা কি সুদূর প্রসারিভাবে অগ্রসর হবে? না গরম ভাত খেতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলবে।