মা ইলিশ রক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। ইতোমধ্যে সুবিশাল সমুদ্র, উপকূলীয় অঞ্চল এবং নদীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে তারা। শুধু অভিযানই নয়, মা ইলিশ রক্ষায় জেলেদের সচেতন করতে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। একই সাথে প্রতিবেশী দেশের জেলেরা যাতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরতে না পারে সে ব্যাপারেও কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে।
গত ৪ অক্টোবর থেকে সারা দেশে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৫’ শুরু হয়েছে। ২২ দিনব্যাপী এ অভিযান চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময় ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে। জানা গেছে, ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজগুলো সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৫’ পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ অভিযানের অংশ হিসেবে চাঁদপুর এলাকায় বানৌজা ধানসিঁড়ি বা শহীদ ফরিদ ও বিএনডিবি গাংচিল; কক্সবাজার এলাকায় বানৌজা অতন্দ্র, শহীদ মহিবুল্লাহ, দুর্জয়, সাগর ও শহীদ দৌলত; খুলনা এলাকায় বানৌজা মেঘনা, চিত্রা বা তিতাস; বাগেরহাট এলাকায় বানৌজা করতোয়া, আবু বকর বা দুর্গম; পিরোজপুর ও বরগুনা এলাকায় বানৌজা সালাম ও কুশিয়ারা; বরিশাল এলাকায় বানৌজা পদ্মা, চিত্রা বা তিতাস এবং পটুয়াখালী এলাকায় এলসিভিপি-০১৩ বিশেষভাবে টহল দিচ্ছে।
এ দিকে মৎস্য উপদেষ্টা বলেছেন, ইলিশ রক্ষায় কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ড্রোনসহ অধুনিক যন্ত্র কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব যন্ত্র হাতে আসলে মা মাছ রক্ষায় নজরদারি আরো জোরদার হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কোস্টগার্ড সবরকম ব্যবস্থা নিয়েছে। বিধিনিষেধ কার্যকর করতে নদী ও সমুদ্র উপকূলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা টহল পরিচালনার পাশাপাশি জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হচ্ছে এবং সবাইকে আইন মেনে চলার আহ্বান জানানো হচ্ছে। একই সাথে জেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, নৌবাহিনী, পুলিশও মা ইলিশ সংরক্ষণে কাজ করছে।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই বাংলাদেশ কোস্টগার্ড দেশের সুবিশাল সমুদ্র, উপকূলীয় এবং নদীতীরবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় জাটকানিধন প্রতিরোধ, মা ইলিশ সংরক্ষণ এবং সমুদ্রে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞাকালীন কঠোর নজরদারি এবং প্রতিনিয়ত অবৈধ জাল ও আর্টিসানাল ট্রলিং বোটের বিরুদ্ধে কোস্টগার্ডের অভিযান অব্যাহত থাকায় মেঘনা নদীতে ইলিশের প্রাচুর্য দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেরা
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে টানা ২২ দিন দেশের উপকূলীয় নদ-নদী ও সাগরে ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। লক্ষ্য একটাই মা ইলিশকে নিরাপদ প্রজননের সুযোগ দেয়া।
ট্রলার মালিক লাবু মিয়া বলেন, আমরা নিষেধাজ্ঞা মেনে ফিরছিলাম। অথচ দেখলাম শত শত ভারতীয় ট্রলার আমাদের জলসীমায় মাছ শিকার করছে। তারা যদি এভাবে মাছ ধরে, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা কিভাবে টিকব?
বরগুনার শামীম মাঝি বলেন, বাংলাদেশের জেলেদের নিয়ম মানতে হয়, কিন্তু ভারতের জেলেরা অবাধে মাছ ধরে। দুই দেশেই একই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ না করলে মা ইলিশ রক্ষা সম্ভব নয়। আরেক জেলে মাঝি আলম মিয়া বলেন, ২০ বছর ধরে মাছ ধরি, কার্ডও আছে। কিন্তু সময়মতো সহায়তা পাই না। ২৫ কেজি চাল দিয়ে সংসার চলে না। ঋণ শোধ করতে না পেরে চিন্তায় দিন কাটছে আমাদের।
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, শুধু চাল দিয়ে হবে না, নগদ অর্থ সহায়তাও দিতে হবে। তা না হলে এ উপকূলের জেলেরা ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়বেন। তিনি আরো বলেন, চলতি মৌসুমে একাধিক ঘূর্ণিঝড়ে জেলেরা আগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর আগে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় তাদের কাক্সিক্ষত মাছ ধরা সম্ভব হয়নি। এখন আবার টানা ২২ দিনের বিরতি। একদিকে মাছ শিকার বন্ধ, অন্য দিকে ঋণ শোধের চাপ, সংসারের খরচ সব মিলিয়ে জীবনে নেমেছে অনিশ্চয়তা।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্য অফিসার মো: মহসীন নয়া দিগন্তকে বলেন, চলতি অবরোধের সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে চাল সহায়তা প্রদান করা হবে। বরগুনার বিষখালী, বলেশ্বর, বুড়ীশ্বর ও পায়রা নদীর ৪০টি পয়েন্টে মৎস্য বিভাগের কঠোর টহল ও নজরদারি থাকবে। অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।