সুন্দরবনে শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগা এখন আর দুর্ঘটনা নয়; বরং নিয়মিত ও পরিকল্পিত ঘটনা। গত ১৯ বছরে অন্তত ৩০ বার অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে দেশের এই বিশ্ব ঐতিহ্য। প্রতিবারই তদন্ত হয়, গঠিত হয় কমিটি। কিন্তু রহস্যজনকভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উঠে আসে না। তবে নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এসব আগুন ‘লাগে না’, লাগানো হয়! উদ্দেশ্য, অগভীর জলাশয়ের মাছ উৎপাদন বাড়ানো এবং মাছ ধরার সুবিধা তৈরি।
সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর, কলমতেজি ও গুলিশাখালি এলাকায় বর্ষার মৌসুমে জন্ম নেয় শিং, মাগুর ও কৈ মাছ। এ মাছের চাহিদা ও দাম বেশি। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র মাছের প্রজনন ও আহরণের সুবিধার্থে বর্ষার আগমনের আগেই মার্চ-এপ্রিল মাসে বনের নির্দিষ্ট জায়গায় আগুন লাগিয়ে জলাশয় প্রস্তুত করে নেয়।
বন বিভাগেরই একটি সূত্র জানায়, বনের নির্দিষ্ট এলাকা আগুনে পুড়িয়ে মাছের আবাস উপযোগী করে তোলার এই চক্রে জড়িত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তারাও। ২০০৭ সালে ড্রেজিং করে বনসংলগ্ন ভোলা নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় মিষ্টি পানির বিল ও জলাশয় তৈরি হয়। বর্ষায় এসব বিলে মাছ ডিম ছাড়ে এবং তা বড় হয়ে ওঠে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে। তখনই শুরু হয় মাছ শিকারের মহোৎসব। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। ২২ মার্চ টেপার বিল এলাকায় আগুন লাগে, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে ২৪ ঘণ্টার বেশি। পরদিন ২৩ মার্চ নতুন করে আগুন লাগে শাপলার বিল এলাকায়, যা ছিল আরো ভয়াবহ। আগুন নেভানোর পর গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, তবে আগের মতোই অদৃশ্য কারণে সেখানেও সত্য আড়ালেই থেকে যায়।
চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) দীপেন চন্দ্র দাস সংবাদমাধ্যমকে বলেন, টেপার বিলের আগুনের চেয়ে শাপলার বিলে আগুন অনেক বেশি বিপজ্জনক। এরপর এ আগুন লাগার কারণ নির্ণয় এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ মূল্যায়নের জন্য সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ এসিএফ দীপেন চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে ধানসাগর স্টেশন অফিসার বিপুলেশ চন্দ্র দাস এবং কলমতেজি ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে।
প্রত্যেকটি ঘটনার পর গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, উচ্চতর তদন্ত কমিটি। প্রত্যেক কমিটিতে সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও তদন্ত রিপোর্টে স্ক্রিপটেড সেই এইক বুলি বারবার আওড়ানো হয়। কারণ এর পেছনে কাজ করে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যার সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত বন বিভাগেরও কিছু অসাধু কর্মকর্তারা। বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০০৬ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে ৩০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যাতে প্রায় ৯০ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। আগুন পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলাধীন এলাকাতেই লাগে। এ পর্যন্ত এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে অন্তত কয়েক শ’। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, আর তদন্তে উঠে এসেছে একঘেয়ে ব্যাখ্যা। সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তারা বলেন ‘ওয়াইল্ড ফায়ার’, ‘মৌচাক ভাঙতে গিয়ে মৌয়ালদের লাগানো আগুন’, কিংবা ‘স্যাবোটাজ’। তবে অনুসন্ধান বলছে, প্রকৃত কারণ ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করা হয়, আড়ালে রাখা হয়।
এ ব্যাপারে বাগেরহাটে অবস্থিত সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমি অল্পদিন হলো এখানে যোগ দিয়েছি। আগুন লাগার তদন্ত রিপোর্টে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে একই কথা বলা হয়েছে। তবে আমার মনে হয় আগুন লাগানো হয়। মাছের জন্য লাগানো হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে নজর রাখব। পরিবেশবিদদের মতে, সুন্দরবনের এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড শুধু গাছপালা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করে বনের বাস্তুতন্ত্র, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্য। সুন্দরবনের মতো একটি সংরক্ষিত ও জলবায়ু প্রতিরোধক বন বারবার পরিকল্পিত আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। যখন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার কথা বলা হচ্ছে সর্বত্র, তখন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে কিছু মানুষের লোভে পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে দেয়া শুধু অবিচার নয়, একটি ভয়ঙ্কর সঙ্কেত। আর বারবার তদন্ত করেও সত্য আড়াল রাখাটা যেন এই সঙ্কেতকে আরো জোরালো করে তুলছে।