আবারো বলছি আমরা পর্যবেক্ষক বটে, তারপরও দৃঢ়তার সাথে বলব, আমাদের কিন্তু আরো একটি পরিচয় আছে, আমরা আপনাদের মতো এ দেশের নাগরিক এবং আজও এ কথা বহাল আছে যে, এ দেশের ‘মালিক মোক্তার জনগণ’ তথা নাগরিক। আমরাও নাগরিক, এ কথা কেউ ভুলবেন না। আপনাদের মধ্যে যেমন খলনায়ক আছে, আমাদের মধ্যে কিছু পদলেহী ছিল, এখনো আছে। আপনাদের এখন যেমন কথা বলার সুযোগ হয়েছে, আমাদেরও লেখার সুযোগ এসেছে। আসুন সবাই এর সদ্ব্যবহার করি। সবাই আগামী দিনের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখি
রাজনীতির সংজ্ঞা এখন যা-ই হোক না কেন, তা এখনো বাংলাদেশে অচল। অব্যবহিত পূর্বপর্যন্ত বহু শতকের পুরনো রাজনীতির সংজ্ঞাই বাংলাদেশে বহাল ছিল। ওই সংজ্ঞা ছিল, সে বহুকাল আগের মানুষের অভিজ্ঞতাজনিত ধারণা থেকে- রাজার নীতি রাজনীতি। অর্থাৎ রাজা যা বলবেন, করবেন তখন তাই ছিল রাজনীতি। তা-ই ছিল প্রশ্নাতীত বিশুদ্ধ রাজনীতি। সম্প্রতি পতিত আওয়ামী জমানায় রাজনীতি ছিল, বহু শতক আগের মতো। শেখ হাসিনার পারিষদের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল ছিল, ‘কিং কেন নো ডু রং’। রাজা কখনো ভুল করতে পারেন না। সে জমানায় রাজা যখন যা বলতেন, পারিষদ, চর-অনুচররা দন্ত বিকশিত করে উচ্চকণ্ঠে সমস্বরে বলত মারহাবা, মারহাবা, কবুল, কবুল-তুলনাহীন। অনেকে সে জমানাকে বলতে পারেন মগের মল্লুক। চোখ থাকতে অন্ধ, কথা বলা ছিল বন্ধ, আর কানের মধ্যে ছিল তুলো, বাইরের কোনো কথা শুনলে তাতে ছিল ভয়। আর তাদের স্লোগান ছিল ‘ওলট-পালট করে দেয় মা লুটেপুটে খাই’।
চব্বিশের জুলাইয়ে অচিন্ত্যনীয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে, হাসিনার রাজত্বের অবসান ঘটে। তবে এখন রাজনীতির প্রকৃত সংজ্ঞা বিকাশের ধারায় থাকলেও পূর্ণতায় পৌঁছেনি। রাজনীতির সংজ্ঞায় রয়েছে অবিচ্ছেদ্য একটি বিশেষ্য- ‘টলারেন্স’ তথা ধৈর্য্য পরমতসহিঞ্চুতা। এ ধৈর্য্য ও পরমত শ্রবণের অভাব যেন দিন দিন বিস্মৃত হচ্ছে। এটা তো কাম্য নয়। তা ছাড়া পতিত জমানায় জনধিকৃত কিছু কর্মকাণ্ড এখনো বহালতবিয়তে রয়েছে যেন আপন মহিমায়। প্রকৃত রাজনীতির সংজ্ঞায় আরো সংযোজিত ছিল, রাজনীতির সমার্থক হবে, শাসন নয় দায়িত্ব পালন, রাষ্ট্র ও জনগণকে সেবাদান। তবে এখনো পতিত যুগের মতো রাজনৈতিক মহলে রয়ে গেছে, ক্ষমতা গ্রহণ, জনগণকে শোষণের বাসনা। রাষ্ট্রশাসনের আকাক্সক্ষা এখনো অনেক রাজনীতিকের দিন-মানের ‘জপতপ’ হয়ে আছে। আজও যদি এমন ধারণার রাজনীতিকদের মধ্যে ‘বোধ বিবেচনা’ জাগ্রহ হয়। প্রশ্ন থাকবে, পরিবর্তন তাহলে কোথায় এবং কোন বন-বাদাড়ে লুকিয়ে আছে। শত প্রাণের রক্তদানের প্রতিদান কার ঘরে ঢুকছে। নাকি ডুবে যাবে বঙ্গোপসাগরে।
এখন এমন আকুতি বহু জায়গা থেকে শোনা যাচ্ছে, বিশেষ করে কোনো কোনো রাজনৈতিক মহল থেকে বলা হচ্ছে, তারা এখন রাষ্ট্রসেবা-জনসেবা দিতে চাতকের ন্যায় কাতর। কষ্টে থাকা জাতি ও রাষ্ট্র এখন সেবা পেতেও অধীর। দীর্ঘ দেড় দশক পতিত সরকারের সময়ে দেশ ও দশ তাদের কাছ থেকে সেবার মোড়কে শুধু কুইনাইন গিলেছে, পেষণ-নির্যাতন ভোগ করেছে। এখন কেউ, অযাচিতভাবে সেবা দেয়ার কথা শুনলে তাদের পিলে চমকে ওঠে। হৃদয় ভয়ে কুঁকড়ে যায় নিকট অতীতে সেবার স্বরূপ মনে করে। তবে বিজ্ঞজনের অভিমত, এখনো রাজনীতির সাধারণ শৈলী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যাচ্ছে না। সেটি অনুসৃত হওয়া দূরের কথা, ছায়ার দেখা মেলাও ভার।
রাষ্ট্র ও জনগণকে সেবাদান গণতন্ত্রের আচারশৈলীর এক অনন্য অনুষঙ্গ। এখনো অতীতে যত ‘সেবা’ দানের রূপ-স্বরূপ থেকে মানুষ সবে রেহাই পেয়েছেন। তাদের হাঁপছাড়ার সময় দিতে হবে। এখন এত দ্রুত এত সেবকের আগমন খুব কি প্রয়োজন। নিকট অতীতে যারা রাষ্ট্র-জনতার সেবক হিসেবে হাজির ছিল, হুজুরের নির্দেশে সবাই গলদঘর্ম ছিল। সেই সেবকরা কেমন ছিল, তারা আসলে ‘সে-বক’ ছিল। যারা খালের ধারে, বিলের পারে, নদীতীরে সুঁচালো ঠোঁট পানিতে ডুবিয়ে টপাটপ মাছ গিলেছে আর উদর পূর্তি করে উড়াল দিয়েছে। তবে নীড়ে ফেরেনি। কেবল খালবিলের ওপর দিয়ে আকাশে বৃত্তাকারে ঘুরেছে। খানিক পরে আবার বিলের মাঝে ছোঁ মেরেছে, মাছ ধরেছে। এমন ছিল সেই ‘সেবকদের’ সেবাদানের যত রকমফের।
জনগণ যাতে যথার্থ সেবা পেতে পারেন, আর কখনো যেন কেউ তাদের সেবাদানের নামে প্রতারিত করতে না পারে; তার একটি স্থায়ী টেকসই বন্দোবস্ত করতে হবে। সে পথে চলা অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে কোনো ‘দল’ বা ‘বলের’ দিকে তাকানোর খুব কি প্রয়োজন আছে। তারা কি কোনো দলের মদদে দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছেন। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিপ্রায়ে তাদের ঘাড়ে দায়িত্ব চেপেছে। তাহলে সর্বাগ্রে জনগণের অভিলাষ তাদের কাছে প্রাধান্য পেতে পারে। যে বন্দোবস্ত জনগণের চাওয়া-পাওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত, তাকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিতে সময় বলছে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধায় ভোগা সঠিক বোধবিবেচনা নয়। সময়ের এক ফোঁড়, আর অসময়ের দশ ফোঁড়ও কোনো কাজে আসে না। সময় বহমান, সে জন্য সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। কাল ফুরালে, সে আর কখনো কূলে ফেরে না।
আবার না হয় ফিরে যাওয়া যাক, যে বন্দোবস্তের কথা বলেছি সেখানে। এ উপমহাদেশে রাজনীতিতে শামিল ব্যক্তিদের মধ্যে অভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা ব্যক্তি-দলের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে আর কোনো নতুন ভাবভঙ্গিমার সাথে মিলে যেতে চান না। সেটি সবার বিবেচনায় ভালো হলেও, বাংলাদেশেও অনেকে সে সমীকরণে ভিন্ন অবস্থানে। তবে বাগ-বাগ্মিতায় এতটুকু পিছিয়ে থাকেন না তারা, উচ্চকণ্ঠে বলেন, আমরা দেশ ও দশকে সব প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসায় সিক্ত করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আমরাই আমাদের বিকল্প, আর কেউ নয়। রাষ্ট্রের ক্ষমতা পেলেই হলো। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এ বোধ-অহংবোধের একটি নমুনা, সাথে আরো আকাক্সক্ষা।
আসলে রাজনীতি নিয়ে কোনো খোলামেলা কথা বলা আমাদের জন্য নয় তথা সংবাদকর্মীদের। এ মতামতের মূল্য কেউ দিক বা না দিক, সেটি ভাবতে চাই না। রাজনীতি নিয়ে সংবাদকর্মীদের সর্বোচ্চ অবস্থান কেবল পর্যবেক্ষণ করা। এটাও ঠিক, খুব কাছ থেকে কিছু দেখলে সবকিছু দেখা যায় না। দূর থেকে পর্যবেক্ষণে সত্য পরিস্ফুট হয়। এ পর্যবেক্ষকের অবস্থান থেকে যে বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে কিছুটা পরিশীলিতভাবে বলা যায় সংস্কার। ছোটখাটো সংস্কার প্রতি মুহূর্তে করা যায়, প্রয়োজনে বিকল্পও কিছু করা যায়; কিন্তু মৌলিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নতুন বন্দোবস্তে সময় সুযোগ বড় গুরুত্বপূর্ণ, বারবার তা আসে না, আর হাতছাড়া হলে কখনো তা আর হাতে ফিরবে না। যে জলস্রোত সমুদ্রে মিলায়, তাকে আর কখনো ফেরানো যায়? সেটি কল্পনাতীত।
অতীতে সংস্কারের ভাগ্যে কী হয়েছে, আসুন সেটি জেনে নেয়া যাক। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে একজন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান মৌচাকে ঢিল না দিয়ে অতীতচারণের মধ্য দিয়ে যে কথাগুলো সাদামাটাভাবে লিখেছেন, তা আকলমান্দের জন্য ইশারা-ই কাফিসম। ড. জাহানের লেখাটায় আছে, ‘১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা হলেন রেহমান সোবহান। বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতির নানা দিকের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, তার বিশ্লেষণ এবং আগামী পথযাত্রার রূপরেখা দেয়ার জন্য তিনি দেশের প্রায় আড়াই শ’ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, চিকিৎসক-প্রকোশলী অন্যান্য বিশেষজ্ঞকে নিয়ে ২৯ কর্মদল গঠন করেন। তার ডাকে তারা সবাই কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই এই বিশাল কাজ করে দিতে সম্মত হন। আমি নিজে সামষ্টিক অর্থনীতি এবং যমুনা সেতু কর্মদলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। প্রথম কর্মদলটির দলনেতা ওয়াহিউদ্দিন মাহমুদ দ্বিতীয়টির জামিলুর রেজা চৌধুরী। রেহমান সোবহানের স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশের নানা বিষয় ও নানা খাতের ওপর এমন একটি কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হলে পরবর্তী সময়ে যে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাই আসুক না কেন, তারা এসব কর্মদলের প্রতিবেদন থেকে একটি দিকনির্দেশনা পাবে। যাকে সংস্কার প্রস্তাব বলা যেতে পারে। সব চেয়ে দুঃখের বিষয় হলো যে, তার পরের কোনো নির্বাচিত সরকার সেসব প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন বিষয়ে কিছুই করলেন না। এটাই রাজনীতির সীমাবদ্ধতা।
যা হোক, ড. জাহানদের জাতির কল্যাণে এমন পরিশ্রম কখনোই রাজনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্ব পায় না, এটাই বোধ হয় নিয়তি। অথচ এমন এক ব্যবস্থাপত্র রাষ্ট্রের নানা রোগ সারাতে পারত। তাহলে জাতি আর রাষ্ট্রকে এখন ধুঁকে ধুঁকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হতো না। এমন সব ব্যবস্থা বা বন্দোবস্ত, বহুবার অতীতে অবহেলার শিকার হয়েছে। বর্তমানে যে বন্দোবস্ত বা সংস্কার প্রস্তাব হচ্ছে তার কি কোনো মূল্য আশা করা যায়। ইতোমধ্যে রাজনীতির অঙ্গনে সংস্কার নিয়ে নানা কথা বলা হচ্ছে। রাজনীতিকদের অনেকে মনে করতে পারেন, যেকোনো বন্দোবস্ত তাদের স্বাধীনতার (পড়তে হবে স্বেচ্ছাতারিতার) দুয়ারে তালা লাগাতে পারে। এমন ধারণা যদি রাজনীতির অঙ্গনে বহাল থাকে, তবে কোনোকালে কি এমন রাজনীতি দেশ ও দশের ভাগ্য বদলের কিঞ্চিত অবদান রাখতে পারবে? এর বড় প্রমাণ তো ৫৩ বছরের বাংলাদেশ। এখনো এখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তারপরও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের লোকজন বুকচিতিয়ে বীরদর্পে হাঁটেন, কথা বলেন। কেমন করে এভাবে হাঁটেন জানি না।
আবারো বলছি আমরা পর্যবেক্ষক বটে, তারপরও দৃঢ়তার সাথে বলব, আমাদের কিন্তু আরো একটি পরিচয় আছে, আমরা আপনাদের মতো এ দেশের নাগরিক এবং আজও এ কথা বহাল আছে যে, এ দেশের ‘মালিক মোক্তার জনগণ’ তথা নাগরিক। আমরাও নাগরিক, এ কথা কেউ ভুলবেন না। আপনাদের মধ্যে যেমন খলনায়ক আছে, আমাদের মধ্যে কিছু পদলেহী ছিল, এখনো আছে। আপনাদের এখন যেমন কথা বলার সুযোগ হয়েছে, আমাদেরও লেখার সুযোগ এসেছে। আসুন সবাই এর সদ্ব্যবহার করি। সবাই আগামী দিনের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখি।