বাজেট নিয়ে সাক্ষাৎকার : ড. মাহবুব উল্লাহ

সংস্কার না হলে রাজস্ব আয় বাড়বে না

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
ড. মাহবুব উল্লাহ
ড. মাহবুব উল্লাহ

অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রেখে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে আস্থা ধরে রাখতে পারলে আমরা অনেকখানি এগিয়ে যাবো। তিনি বলেন প্রস্তাবিত বাজেটের আকার কত বড় হলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর বাস্তবায়ন পর্বে একটা দর্শন থাকা উচিত। এ ধরনের দর্শনের অভাব রয়েছে বাজেটে। তিনি নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, করের আওতা বৃদ্ধি করতে পারলে বাজেটে একটা বৈপ্লবিক চেহারা তৈরি করা যেতে পারত। আবার বাজেট বরাদ্দে সদ্ব্যবহার হচ্ছে কি না সেটাও জরুরি। কত টাকার বিশাল বাজেট সেটা বড় কথা নয়, বরাদ্দের সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, এক্ষেত্রে ইমপ্রুভমেন্ট আনা সম্ভব হচ্ছে কি না তার তদারকি প্রয়োজন।

শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন বাজেটে নতুনত্ব কখনো দেখিনি। যা কিছু ঘটছে, যা কিছু হচ্ছে সবই ধারাবাহিক এবং গতানুগতিক। এবারের বাজেটও সেই গতানুগতিক কথার বাইরে যায় নাই। মোট বরাদ্দের ব্যাপারে দেখা যায় গতবারের তুলনায় এবার সাত হাজার কোটি টাকা কম বরাদ্দ, এ কমটা মানে সরকার একটা ঢাউস বাজেট তৈরি করার যে রাস্তা যে পথ সেখান থেকে সরে আসে নাই। শেখ হাসিনা যে ঐতিহ্য তৈরি করে গেছে সেই ঐতিহ্যে বর্তমান সরকার আছে। যে কারণে বাজেটের আকার হলো সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের চেয়ে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এখানে যে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা খুবই অ্যাম্বিশাস বা উচ্চাভিলাষী। অতীতের অভিজ্ঞতায় যেটা বলে আমাদের এনবিআর বা ট্যাক্সেশন অথরিটি যারা আছেন তারা এ বিশাল অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত বাজেটটা যেভাবে প্রস্তাবনা করা হয়েছে সেভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না কারণ অর্থের অভাব। অর্থ ওভাবে পাওয়া যাবে না, আয় ওভাবে আসবে না রাজস্ব খাত থেকে। এবং রাজস্ব আয় রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যাবে বা দেড়গুণ হয়ে যাবে এটাও মনে করার কোনো কারণ নাই। যদি ব্যাপক আকারে কোনো সংস্কার প্রবর্তন না করা হয়। আবার খুব চিন্তাভাবনা করে কিভাবে রাজস্ব আয় বাড়ানো যায়, সেখানে কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, সে ব্যাপারে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সবধরনের পদক্ষেপ কী হতে পারে সেটা চিন্তা করেই কিন্তু আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

নয়া দিগন্ত : কিন্তু এখন তো অন্তর্বর্তী সরকারকে একদিকে সংস্কার অন্য দিকে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের দিকে নজর দিতে হচ্ছে?

ড. মাহবুব উল্লাহ : যেহেতু বাজেট বাস্তবায়নে সেই ধরনের চিন্তাভাবনা নাই, সেহেতু খুব বেশি কিছু আশা করা যায় না। এটা একটা, আর হলো বাজেটের যেটা ডেভিশিয়েট বা ঘাটতিও বিশাল, ঘাটতির একটা অংশ আসছে দেশীয় উৎস থেকে আরেকটা বিদেশি ঋণ সাহায্য থেকে আসছে, এ ছাড়া প্রতি বছর বাজেটে বড় একটা অঙ্ক বা টাকা, ঋণের ওপর সুদ বা দায় পরিশোধ করতে ব্যয় হয়, এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না। ফলে প্রকৃত অর্থে ব্যয় করার জন্যে মানে যে বাজেট আমরা দেখছি আকারে সেই পরিমাণ অর্থ কিন্ত ব্যয় হবে না।

নয়া দিগন্ত : তাহলে বাজেটের কোন কোন বিষয়ের ওপর নজর দেয়া জরুরি?

ড. মাহবুব উল্লাহ : কর আরোপের ব্যাপারে তেমন কোনো অভিনবত্ব নেই, কী বিবেচনায় কোথায় বাড়ানো হল, বিবেচনাগুলো খুব স্পষ্ট না। এখন পর্যন্ত যা দেখছি আরকী। হয়তো বাজেট ডকুমেন্টশনে তার ব্যাখ্যা করা হবে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার জন্যে যে বেষ্টনী সেটাও বেশ অপ্রতুল। পরিমাণ কমে গেছে। দরিদ্র দেশে যেসব মানুষ অর্থনৈতিক সঙ্কটে আছে সেখানে এটা আশা করা যায় না। এটাকে তখন সাধুবাদ জানাব যখন দেখব বরাদ্দকৃত অর্থ যাদের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে, যাদের টার্গেট করে সামাজিক নিরাপত্তা জাল তৈরি করা হয়েছে সেই টার্গেট গ্রুপের কাছে যেন যথাযথভাবে টাকাটা গিয়ে পৌঁছায়। তো সেটা করার আগে শুধু খাতা-কলমে বরাদ্দ বেশি বা কম সেটা আমার কাছে খুব বেশি মূল্যবান মনে হয় না।

নয়া দিগন্ত : যে সব খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল তা কি এবার সম্ভব হয়েছে?

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বলা হয়েছিল বরাদ্দ বাড়ানো হবে, কিন্তু সেটা সেভাবে বাড়ানো হয়নি। মোট অঙ্কের টাকা প্রায় একই রকম রয়ে গেছে বা কিছু কমেও গেছে। দেখেন বাজেটের একটা দর্শন থাকা উচিত। আবার অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা বলি তার দায়িত্ব হল দর্শনটা ব্যাখ্যা করা। কোন দর্শনের আলোকে তিনি বাজেটটা দিলেন, এটা কি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্যে নাকি আয় বণ্টন যেটা আছে সেটা আরো সহনীয় করার জন্যে বা আয় বণ্টনে বৈষম্য কমানোর জন্যে, সংস্কার করার জন্যে এসব দর্শন থাকা উচিত। আবার প্রত্যক্ষ কর কী পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে তা পত্রপত্রিকা পড়ে আমার কাছে স্পষ্ট মনে হয়নি। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো উচিত, কারণ বাজেটটা এখনো আমাদের পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর থেকে গেছে। বিশেষ করে আয়কর যদি বৃদ্ধি করা যায় তো বাজেটের একটা বৈপ্লবিক চেহারা করা যাবে।

নয়া দিগন্ত : তার মানে করের আওতা আরো বৃদ্ধি করার কথা বলছেন?

ড. মাহবুব উল্লাহ : আয়কর বৃদ্ধি করা মানেই হচ্ছে ইনকাম ডিস্ট্রিবিউনশনটা এখনো অসাম্যের মধ্যে রয়ে গেছে। যেটা একটু হলেও সামনের দিকে আস্তে আস্তে আগাতে হবে। সেইটা করার জন্যে কী কায়দা বা কৌশল সেটাও আমি স্পষ্ট দেখছি না বাজেটে। কিন্তু বাংলাদেশে আয়কর আদায় বা বিস্তৃতি করার অনেক সুযোগ রয়েছে। দেশে হচ্ছে না হচ্ছে না বলেও কিন্তু প্রচুর পরিমাণ ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটিস হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে পেশার মানুষ বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করছে, রোজগারও করছেন। বিশেষ করে মহাসড়কগুলোতে প্রচুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। উদাহরণ হিসেবে চায়ের দোকান বা অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে করের আওতায় আনার চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত। এ ধরনের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বছরের শেষে কিন্তু কম টাকা আয় করছেন না। তিনি নিঃসন্দেহে কর দিতে সক্ষম। এসব দিক খেয়াল করলে করের আওতা বিস্তৃত করা সম্ভব।

নয়া দিগন্ত : তো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়ে গেল, বলা হচ্ছে সংস্কারের সাথে এটা যায় না..

ড. মাহবুব উল্লাহ : এটাতো পুরোনো কাহিনী। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ যে দেয়া হয় বা রেয়াত বা প্রণোদনা দেয়া হয় তা খুব কার্যকর হয় না। বছরে একশ দুইশ কোটি টাকা এটাতো একেবারেই বাজেটে পিনাট।

নয়া দিগন্ত : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিভাবে রাখা যায়?

ড. মাহবুব উল্লাহ : মূল্যস্ফীতি কমানোর খুব একটা সুযোগ আমি দেখি না। একবার মূল্যস্ফীতি হয়ে গেলে তা আর কখনো নামতে চায় না, স্ফীতির হারটা কমানোর জন্যে চেষ্টা করা কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা দিয়েছে সরকার, আমার যেটা অভিজ্ঞতা যখনি সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা বাড়ে তখন দোকানদার বলতে থাকে কাঁচাবাজার করতে গেলে, স্যার আমাদের তো ভাতা নেই, তো পণ্যের মূল্য একটু বাড়তি দেবেন না কেন। অর্থাৎ এটা থেকেও একটা ইনফ্লেশন বা বৈষম্যের সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সামগ্রিকভাবে ইনফ্লেশনটা নির্ভর করে আমদানির ওপর, যেহেতু আমাদের অর্থনীতি আমদানি নির্ভর, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তা বাজারে আমদানিকৃত জিনিসের ওপর বাড়তি মূল্য যোগ করে, আরেকটা হলো এক্সচেঞ্জ রেট। টাকার সাথে ডলারের মূল্যমানে যে পার্থক্য, এক ডলারে ধরেন এখন ১১৬ টাকা, যে ব্যবসায়ী এ মূল্যমানে আমদানি করবে স্বাভাবিকভাবে স্থানীয় মুদ্রায় তার ব্যয়টা অনেক বেড়ে যাবে। এ দু’টি ফ্যাক্টর এখন পর্যন্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন যদি রিজার্ভ বাড়ানো যায় মানে রেমিটেন্স বা রফতানি আয় বৃদ্ধি করে দেশের অভ্যন্তরে ডলার বা বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো যায়। আবার বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে পারলেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়। তবে এটা তো সুদূরপ্রসারী বা দীর্ঘমেয়াদি একটা ব্যাপার শর্টটার্মে তেমন কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না। আর একটা হচ্ছে রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে ডলার ও টাকার মূল্যমান বাজারে নির্ধারিত হলে হুন্ডির ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করা যায়। বেশির ভাগ রেমিটেন্স যাতে সরকারি বা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে সেদিকে লক্ষ রাখা। এভাবে কিছু রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তেও পারে।

নয়া দিগন্ত : বাজেটে মূল ফোকাস কী থাকা প্রয়োজন?

ড. মাহবুব উল্লাহ : কত অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করা হলো বা কত লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেট বরাদ্দ দেয়া হলো সেটা বড় কথা নয়; তার চেয়ে বরং এ বরাদ্দকৃত টাকার সদ্ব্যবহার হচ্ছে কি না তা সবচেয়ে বড় কথা। দুর্নীতি হচ্ছে কি না- এটা বিরাট প্রশ্ন। মানে কোয়ালিটি অব এক্সপেন্ডিচার। এর কোনো বিকল্প নাই। প্রকল্পের জন্যে টাকা বরাদ্দ দিলেন, বরাদ্দের পরিমাণ সঠিক কি না সেটাতো কস্ট বেনিফিট অ্যানালাইসিস আছেই বা প্রকল্পের সাথে যারা জড়িত থাকেন তারা নির্ধারণ করেন, কিন্তু সেখানে যদি গলদ থাকে, প্রকল্প বাস্তবায়নে যেখানে ৩ শ কোটি টাকা দরকার, সেখানে ৬ শ বা ৫ শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলে এবং এ প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি ইচ্ছাপূর্বক করা হয়, সিগনিফেকেন্টলি প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ করে বাড়তি অর্থ তারা আত্মসাৎ করে। আরেকটা হলো কোয়ালিটি অব এক্সিকিউশন অব দি প্রজেক্ট। সেটাও একটা ইম্পর্টেন্ট ব্যাপার। অবকাঠামো নির্মাণে যথাযথ মানের সিমেন্ট, ইট, সুরকি ইত্যাদি এবং মানসম্পন্ন কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার হলো কি না এটা একটা বড় দিক। সেখানে আবার সুপারভিশন বড় আরেক দিক। নির্মাণ কাজে সময়ে সময়ে যে দেখভাল করার ব্যাপার সেটা থাকতে হবে। এসব কিছু মিলিয়েই কোয়ালিটি অব এক্সপেন্ডিচার ইমপ্রুভ নিশ্চিত করতে হয়। এটার ইমপ্রুভমেন্ট করতে না পারলে টাকা বরাদ্দ করে জনগণের কাছ থেকে টাকা নেয়া হবে তারপর সেটা চলে যাবে অলিগার্কদের হাতে। দুরভিসন্ধিমূলক কিছু লোকের হাতে। এটা না ঠেকাতে পারলে আমরা সত্যিকার অর্থে বড় কিছু অর্জন করতে পারব না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়ে উঠবে না।

নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও তো জরুরি?

ড. মাহবুব উল্লাহ : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে অর্থনীতি ভালো চলে। মানুষ আস্থা পায়। আর রাজনীতিতে অবিশ্বাস, অনাস্থা ইত্যাদি চলতে থাকলে মানুষের মধ্যেও আস্থা কমে যায়। বিনিয়োগে মানুষ সাহস পায় না। বা মানুষ ভালো করে কাজ করতে চায় না। এ ধরনের একটা ব্যাপার হয়। আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা যদি বেড়ে যায় কর্মদিবসও আপনি হারিয়ে ফেলেন। অনেক সময় কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এটা বজায় রাখতে যা করণীয় তা করতে হবে। সেটা নির্বাচনের তারিখ হোক বা সংস্কার হোক, জাতীয় ঐকমত্য ও সমঝোতার মাধ্যমেই সেটা করতে হবে। এবং এতে আমরা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারব।