জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন হবে গণভোটের মাধ্যমে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই আলাদা ব্যালটে গণভোট হতে পারে। এ জন্য গণভোটের আগে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে ইসিকে ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে। গণভোট হবে জুলাই সনদের ওপর। আর সনদের যে ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে নির্বাচিত সংসদকে।
গতকাল মঙ্গলবার অনলাইনে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাথে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ বৈঠকে এমন মতামত উঠে এসেছে বলে বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে। সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের পাশাপাশি একটি বিকল্প প্রস্তাব বা সুপারিশও সরকারকে দেয়ার পক্ষে কমিশন। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ সকালে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাথে ফের বৈঠক করবে কমিশন। সেখানে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আগে ও পরে করণীয় বিষয়ে নানা দিক আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিকেলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে হবে কমিশনের চূড়ান্ত বৈঠক। মূলত সবকিছুর সিদ্ধান্ত আসবে আজকের এই বৈঠক থেকে। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
এ দিকে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার পর গত রোববার জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নে গণভোট অনুষ্ঠানে ঐকমত্যে পৌঁছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কমিশন (ইসি) জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের সমর্থন আছে কি না তা যাচাইয়ে হাঁ-না ভোটের আয়োজন করবে। এ জন্য সরকারকে একটি আদেশ জারির মাধ্যমে ইসিকে গণভোট অনুষ্ঠানের ক্ষমতা দিতে হবে। এর আগে বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছিল, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দিনই এই গণভোট হতে পারে। তবে জামায়াতে ইসলামী বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগেই এই ভোট করতে হবে। সেটা নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসেও করা যেতে পারে। এতে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো সমস্যা হবে না।
এ দিন বৈঠক শেষে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে। এটি জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে দলগুলোর প্রথম পদক্ষেপ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি জানান, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে সে আইনসভা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার করবে তা যেন টেকসই হয়, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য জানান, গণভোটে কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিছু বিষয়ে মতানৈক্য আছে, সেসব বিষয়ে জনগণের অভিমত নেয়া। নোট অব ডিসেন্ট যেগুলো এসেছে আলাদাভাবে সে বিষয়ে মতামত নেয়া। তিনি বলেন, গণভোটের আগে সাংবিধানিক আদেশ জারি হবে। এই আদেশে বলা থাকবে কোন কোন বিষয়ে মতৈক্য আছে আর কোন কোন বিষয়ে মতানৈক্য হয়েছে সেটার আলোকেই গণভোট হবে।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, বিশেষজ্ঞ প্যানেলের আলোচনায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন আদেশ’ বা ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সংবিধান সংশোধন আদেশ’-এ রকম নামে গণভোট করার বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্য দিকে, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন হবে, নাকি আগে হবে- সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। আজ দলগুলো তা নির্ধারণ করবে।
কমিশন সূত্র আরো জানায়, অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গণভোটের আয়োজনের দাবি উঠলেও তা সম্ভব নয় বলে মনে করছে কমিশন। কমিশনের এক সদস্য জানান, এই সরকারের বৈধতার উৎস হলো জনগণের অভ্যুত্থান। বর্তমান সংবিধান মোতাবেক অধ্যাদেশ করা যায় না। তাই সাংবিধানিক আদেশ জারি করতে হবে। গণভোটের বিষয়ে একটা প্যাকেজ হবে, নাকি দু’টি প্যাকেজ হবে- এটা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। বুধবার সকালে আবার বসা হবে। সেখানেই হয়তো চূড়ান্ত করা হবে। গণভোটের পাশাপাশি গণপরিষদ বা আরো বিকল্প নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায়। আজকের বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে চূড়ান্ত আলোচনার পর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে একটা সুপারিশ বা প্রস্তাব দেবে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে গণভোটের পাশাপাশি আরো একটি সুপারিশ থাকতে পারে।
ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর চূড়ান্ত হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫। সনদে উল্লেখিত সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের ৭৩টিতে প্রায় সব দলের ঐকমত্য রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকা, রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া, প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত কমিটির মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগসহ ৯টি সিদ্ধান্তে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। দলটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত হলেও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে র্যাংক চয়েজ ভোটে রাজি হয়নি। তবে সংলাপে অংশ নেয়া ৩০ দল ও জোটের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এসব সংস্কারে একমত হওয়ায় কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দেয়। গত রোববার গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে দলগুলো। তবে বিএনপি বলছে, যে দল যে সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তারা তা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। নির্বাচনে জয়ী হলে সেগুলো বাস্তবায়ন না করার এখতিয়ার তাদের থাকবে।
জামায়াত ও এনসিপি বলছে, নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার সময় জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে গণভোট আলোচনায় ছিল না। তাই কোন দল কী নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তা আর বিবেচ্য নয়। তারা বলছে, নোট অব ডিসেন্ট মানেই হচ্ছে ভিন্নমত থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া। গণভোট হবে জুলাই সনদের ওপর। একটি বা দু’টি দলের ভিন্নমতের চেয়ে জনগণের অভিপ্রায় অনেক ঊর্ধ্বে। গণভোটের ফলাফল অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়নে সবাই বাধ্য।