ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আস্থা ও স্বচ্ছতা রক্ষা

শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি গঠনে নীতিমালা জারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৬ বছরের বেশি সদস্য থাকতে পারবেন না

শরিয়াহ আইন অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা নিশ্চিতে প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দক্ষ শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি (এসএসসি) গঠন করতে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল ইসলামী ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে পাঠানো হয়েছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও প্রায় সব বাণিজ্যিক ব্যাংকেই ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো রয়েছে। এ খাতের সাফল্য নির্ভর করে ব্যাংকের কার্যক্রম কতটা শরিয়াহসম্মতভাবে পরিচালিত হচ্ছে তার ওপর। শরিয়াহ আইন অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা নিশ্চিতে প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দক্ষ শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি (এসএসসি) গঠন করতে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল ইসলামী ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে পাঠানো হয়েছে।

কমিটির গঠন : বলা হয়েছে, প্রতিটি ইসলামী ব্যাংক বা ইসলামী ব্যাংকিং শাখা/উইন্ডোতে এসএসসি গঠন করা হয়। সাধারণত সদস্য সংখ্যা তিন বা পাঁচজন হয়ে থাকে। এর মধ্যে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হবে। এসএসসি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং তাদের কোনো বাণিজ্যিক বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রভাব থাকতে পারবে না

সদস্যদের যোগ্যতা : সার্কুলারে বলা হয়েছে, শরিয়াহ কমিটির সদস্য হতে হলে প্রথমেই প্রার্থীর মুসলিম হওয়া বাঞ্ছনীয়। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতি, ব্যাংকিং, ফিকহ বা ইফতা বিষয়ে ডিগ্রি থাকতে হবে। কামিল/দাওরা-ই-হাদিস বা সমমানের শিক্ষা থাকলে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সার্কুলারে ফিকহ-আল-মুয়ামালাত বা ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে গবেষণা বা প্রকাশনা থাকলে তা বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্তত দুই বছরের শিক্ষকতা বা শরিয়াহ কমিটির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সদস্যদের হতে হবে অপরাধমুক্ত, আর্থিকভাবে স্বচ্ছ এবং ব্যাংকের ব্যবসায়িক স্বার্থের বাইরে অবস্থানকারী। এভাবে সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া কঠোরভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে এসএসসিতে শুধুমাত্র দক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিরাই অন্তর্ভুক্ত হন।

মেয়াদ, পুনঃনিয়োগ ও অপসারণ : সার্কুলারে বলা হয়েছে, সদস্যদের মেয়াদ তিন বছর। একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ছয় বছর একটানা দায়িত্বে থাকতে পারবেন। এর পর অন্তত দুই বছরের বিরতি ছাড়া পুনঃনিয়োগ সম্ভব নয়। পুনঃনিয়োগ বা নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কোনো সদস্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে পর্ষদ কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে তাকে অপসারণ করা যাবে। তবে সদস্য চাইলে নিজেও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারবেন।

চেয়ারম্যান, সচিব ও সচিবালয় : এসএসসির একজন সদস্যকে পর্ষদ কর্তৃক চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের জন্য নির্বাচিত করা হবে। সচিব থাকবেন শরিয়াহ সচিবালয়ের প্রধান, তবে তার ভোটাধিকার থাকবে না। শরিয়াহ সচিবালয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য কর্মকর্তা থাকতে হবে এবং তাদের ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। সচিবালয় হলো কমিটির কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রধান অঙ্গ।

দায়িত্ব ও কর্তব্য : এতে বলা হয়েছে, শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির মূল দায়িত্ব হলো ব্যাংকের প্রতিটি কার্যক্রম শরিয়াহ অনুশাসন অনুযায়ী হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান কার্যাবলি হলো-

পণ্য ও সেবা প্রত্যয়ন : ব্যাংকের সব বিনিয়োগ, আমানত গ্রহণ, ফিন্যান্সিং মডেল, মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন শরিয়াহ অনুযায়ী কি না তা পর্যালোচনা ও অনুমোদন করা।

মুনাফা বণ্টন : ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে মুনাফা বণ্টনের পদ্ধতি শরিয়াহসম্মত কী না তা নিশ্চিত করা।

জাকাত : ব্যাংকের জাকাত হিসাবায়ন ও বণ্টন কার্যক্রম তদারকি করা।

শরিয়াহ অডিট : ব্যাংকিং কার্যক্রমের মধ্যে কোথাও শরিয়াহ অনিয়ম ঘটছে কি না তা চিহ্নিত করা এবং সংশোধনী পদক্ষেপ গ্রহণ।

অবৈধ আয় নিষ্পত্তি : শরিয়াহ নন-কমপ্লায়েন্স থেকে অর্জিত আয় সঠিকভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা।

পর্ষদকে পরামর্শ : শরিয়াহ লঙ্ঘনজনিত জটিলতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালনা পর্ষদকে অবহিত করা এবং সমাধানের পথনির্দেশ করা।

বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিতকরণ : গুরুতর অনিয়ম দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করা।

সভা পরিচালনা : এসএসসির বছরে অন্তত চারবার (ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে) সভা করতে হবে বলে সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী অতিরিক্ত সভা আয়োজন করা যাবে। সভায় সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গৃহীত হবে এবং কার্যবিবরণীতে ভিন্নমত থাকলে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। প্রতিটি কার্যবিবরণী চেয়ারম্যান ও সচিব স্বাক্ষর করে ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে হবে।

প্রতিবেদন ও জবাবদিহিতা : প্রতি বছর এসএসসি একটি বার্ষিক শরিয়াহ কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পরিচালনা পর্ষদের কাছে দাখিল করতে হবে। এর পর দুই মাসের মধ্যে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। একই সাথে প্রতিবেদন ব্যাংকের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করতে করতে হবে। এর ফলে ব্যাংকের গ্রাহক, আমানতকারী ও সাধারণ মানুষ প্রতিষ্ঠানটির শরিয়াহ অনুসরণের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবেন। এ ছাড়া গুরুতর কোনো সমস্যা দেখা দিলে কমিটি বিশেষ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্ট তৈরি করে পর্ষদের নিকট জমা দিতে পারবে।

সদস্যদের মূল্যায়ন : এসএসসি সদস্যদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের জন্য একটি প্রক্রিয়া নির্ধারিত আছে। চেয়ারম্যান অন্য সদস্যদের মূল্যায়ন করেন এবং সদস্যরা চেয়ারম্যানকে মূল্যায়ন করবেন। এ মূল্যায়ন প্রতিবেদন পরিচালনা পর্ষদের কাছে জমা দেয়া হবে এবং তা ভবিষ্যতে পুনঃনিয়োগ বা অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ খাতকে সুসংহত ও টেকসই করতে হলে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির ভূমিকা অপরিসীম। সদস্যদের দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনার ফলে এসএসসি এখন একটি শক্তিশালী তদারকি ও প্রত্যয়ন কাঠামোতে পরিণত হবে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি মানুষের আস্থা ধরে রাখতে এ কমিটির কার্যকর ভূমিকা আরো বাড়াবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে।