পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় যে ঘাটতি তা দিনের পর দিন বাড়ছে। তার প্রকাশ ঘটেছে সপ্তাহের শেষ দিনের লেনদেনে। গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন নেমে আসে ২৫৩ কোটি টাকায়, যা বাজারটির বিগত ২৭ মাসের সর্বনি¤œ। ২০২৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির পর ডিএসইর লেনদেন আর এ পর্যায়ে নামেনি। একদিন আগেও বাজারটির লেনদেন ছিল ৩২৬ কোটি টাকা যা গতকাল অপেক্ষা ৭৩ কোটি টাকা বেশি।
বৃহস্পতিবার দিনের বেশির ভাগ সময়ই দুই পুঁজিবাজারের সূচক ছিল ইতিবাচক ধারায়। তবে এ সময় লেনদেনের গতি ছিল কিছুটা শ্লথ। বেলা ১টা পর্যন্ত বাজারগুলো সূচকের উন্নতি ধরে রাখে। এ সময় ডিএসইর প্রধান সূচকটি ১০ পয়েন্ট উন্নতি রেকর্ড করা হয়। কিন্তু বেলা ১টার পর বাজারগুলোতে হঠাৎ বিক্রয়চাপ বেড়ে যায়। পরবর্তী এক ঘণ্টা এ বিক্রয়চাপ অব্যাহত থাকলে সূচকের অবনতি ঠেকানো যায়নি। দিনশেষে ১৬ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে চার হাজার ৭৮৫ দশমিক ১১ পয়েন্টে স্থির হয় ডিএসইর প্রধান সূচকটি। একই সময় ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ হারায় যথাক্রমে ৪ দশমিক ৫৬ ও ৩ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট।
অপর দিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই ১৪ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট হারায়। এখানে বাজারটির অপর দুই সূচক সিএসই-৩০ ও সিএসসিএক্স সূচকের অবনতি ঘটে যথাক্রমে ৪১ দশমিক ৩৪ ও ১৪ দশমিক ৪৫ পয়েন্ট।
সূচকের পাশাপাশি লেনদেনের এ অবনতি নিয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা দেশের চলমান অস্বস্তিকর অবস্থাকেই দায়ী করেছেন। তাদের মতে, দেশে এ মুহূর্তে যা চলছে তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। এ মুহূর্তে সাধারণ মানুষের মধ্যে মোটেই স্বস্তি নেই। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল তার ছিটেফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই। এ প্রসঙ্গে তারা গত বছরের জুলাই পরবর্তী পুঁজিবাজার আচরণের উল্লেখ করে বলেন, ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতন ঘটে। আর ১১ আগস্ট ডিএসইর লেনদেন ছাড়িয়ে যায় দুই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের এ আস্থাকে আমরা ক্যাপিটেলাইজ করতে পারিনি। পরবর্তীতে দেশের ব্যাংকিংসহ পুরো আর্থিক খাতের অসঙ্গতির পাশাপাশি পুঁজিবাজারের বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া অনিয়মের বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীদের সামনে চলে এলে তাদের আস্থায় ব্যাপক চিড় ধরে। আর এ মুহূর্তে দেশে যা চলছে তাকে কোনোভাবেই বিনিয়োগের পক্ষে বলা যায় না। দেশের সবকিছু যেখানে চরম অচলাবস্থার শিকার সেখানে শেয়ারবাজার ভালো পারফর্ম করার কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে শেয়ারবাজারের উন্নয়ন, প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য আন্তর্জাতিক এক কাস্টডিয়ান ব্যাংকের সাথে বিএসইসির গুরুত্বপূর্ণ এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকটি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাথে বিশ্বের অন্যতম বড় গ্লোবাল কাস্টডিয়ান ব্যাংক ‘দ্য ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক মেলন এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কাস্টডিয়ান ব্যাংক ‘এইচএসবিসি’ এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো: আবুল কালাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা যায়। এতে উল্লেখ করা হয়, বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, কমিশনার ফরজানা লালারুখ, ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক মেলনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ কাসেম, এইচএসবিসি বাংলাদেশের হেড অব গ্লোবাল কাস্টডিয়ান ইনস্টিটিউশনস মনির উদ্দিন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম নাজমুল হোসেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট শাইলা আলম ত্রিশা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি, বাজারের উন্নয়নে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ, বিএসইসির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, বিদেশী বিনিয়োগের সম্ভাবনা, কর কাঠামো, আইন ও নীতিমালার সংস্কার এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বিষয়গুলো আলোচনা হয়। বিশেষ গুরুত্ব¡ দেয়া হয় অটোমেশন, টি-প্লাস ওয়ান সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তিনির্ভর বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর।
এ ছাড়াও, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাস্টডি সুবিধা সম্প্রসারণ, আইনি ও নীতিমালায় যুগোপযোগী সংস্কার এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উপযোগী পরিবেশ তৈরির ওপর আলোচনা হয়। বৈঠকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং টেকসই ও আধুনিক শেয়ারবাজার কাঠামো গড়ে তুলতে বিদেশী অংশীদারদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এ সময় বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, দেশের শেয়ারবাজারকে আরো বিনিয়োগবান্ধব, আধুনিক ও বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এই ধরনের আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ভবিষ্যতে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
গতকাল ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষ তালিকায় ছিল বিচ হ্যাচারি। ১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকায় কোম্পানিটির ৩২ লাখ ২০ হাজার শেয়ার হাতবদল হয় গতকাল। ১১ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় তিন লাখ ১৫ হাজার শেয়ার বেচাকেনা করে ওরিয়ন ফার্মা ছিল দিনের দ্বিতীয় কোম্পানি। লেনদেনের শীর্ষ দশ কোম্পানির তালিকায় আরো ছিল যথাক্রমে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, এস আলম কোল্ডরোল স্টিলস, সোনারগাঁও টেক্সটাইলস, শাইন পুকুর সিরামিকস, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্র্যাক ব্যাংক ও ফু ওয়াং ফুড।
একই সময় চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারের লেনদেনের শীর্ষ দশ কোম্পানি ছিল যথাক্রমে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, লাভেলো আইসক্রিম, বেক্সিমকো লিমিটেড, বসুন্ধরা পেপার মিলস, ওয়ালটন হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং, বিডি ল্যাম্প, রানা অটোমোবাইলস, গোল্ডেন হারভেস্ট, বিএটি বিডি ও ফু ওয়াং ফুডস।
অপরদিকে ডিএসইতে মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে উঠে আসে সোনারগাঁও টেক্সটাইলস। গতকাল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে কোম্পানিটির। ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে এ তালিকায় দ্বিতীয় কোম্পানি ছিল বসুন্ধরা পেপার মিলস। মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায় আরো ছিল যথাক্রমে বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মোপ্লাস্টিকস, এইচ আর টেক্সটাইলস, এস আলম কোল্ডরোল স্টিলস, বিকন ফার্মা, আনওয়ার গ্যালভেনাইজিং, ইস্টার্ন ক্যাবলস, কপারটেক ও এপেক্স ট্যানারি।