পাহাড় নদী মাঠ পেরিয়ে...

Printed Edition
সোমেশ্বরীর তীরঘেঁষা মেঘালয় পাহাড়
সোমেশ্বরীর তীরঘেঁষা মেঘালয় পাহাড়

সীমান্ত আকরাম

দিনটি ছিল জুমাবার। ছুটির দিন। আমাদের ১২ জনের টিম। সবাই সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত। প্রাণবন্ত একটি ভ্রমণের জন্যই লেখক-শিল্পীদের এই আয়োজন। এর মধ্যে টিকিট কাটাও শেষ। বাসে ওঠার পালা। সবাই যার যার আসন গ্রহণ করল। কোলাহল আর যানজটের শহরকে ছুটি দিলাম স্বস্তির নিঃশ^াস আর একটু বিনোদনের জন্যে। আল্লাহ পাকের সৃষ্টিরাজির সৌন্দর্য অবলোকনও আমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য। বিরিশিরি দর্শনের স্বপ্নযাত্রা নিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। ঢাকা থেকে বিরিশিরির দূরত্ব প্রায় ১৭০ কিলোমিটার, যা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত।

নেত্রকোনার অনেকটা আগেই শ্যামগঞ্জ বাজারে বাস থেকে নেমে পড়ি। শ্যামগঞ্জ থেকে দুর্গাপুরের উদ্দেশে সিএনজি নিলাম। সিএনজি আমাদের সোমেশ্বরী নদীর এপারে নামিয়ে দিলো।

বিরিশিরিতে যতগুলো পর্যটন স্পট আছে, সবগুলোই সোমেশ্বরী নদীর ওপারে। সোমেশ্বরী নদী হচ্ছে স্বচ্ছ জল আর ধু ধু বালুচরের জন্য বিখ্যাত। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় থেকে পতিত বিভিন্ন ঝরনাধারা থেকে এর উৎপত্তি। বর্ষা মৌসুমে এ নদীর পানির গভীরতা বাড়লেও শীত মৌসুমে পানির পরিমাণ খুবই কমে যায়, যেন দিগন্ত বিস্তৃত বালুচর। বিরিশিরিতে রয়েছে অনেকগুলো পর্যটন স্পট। তা হলো- বিজয়পুর জিরোপয়েন্ট, কমলা বাগান, গারো পাহাড়, দুর্গাপুরের জমিদারবাড়ি, সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, সোমেশ্বরী নদী এবং নীলচে-সবুজ জলের হৃদ চীনামাটির পাহাড়।

চলে এলাম চীনামাটি পাহাড়ের পাদদেশে। অটো থেকে নেমে কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, আবার কাউকে পোশাক পরিবর্তনে ব্যস্ত দেখা গেল। চীনামাটির লেক আর পাহাড় মিতালীর নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো দেখে মনে পড়ে গেল কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানটি। তিনি লিখেছিলেন- ‘তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর/না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর/সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন/ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর/না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর?’

পর্যটকদের কাছে বিরিশিরি ভ্রমণের মূল আকর্ষণ হলো চীনামাটির পাহাড়। দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বহেড়াতলী গ্রামে এর অবস্থান। এখান থেকে চীনামাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধারগুলো দেখতে বেশ চমৎকার। মৌসুমভেদে এখানকার জলের রঙে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কখনো গাঢ় সবুজ, কখনো বা নীল। এই পানিতে কোনো মাছ বা অন্য কোনো জৈব প্রাণী নেই। এর দেয়াল ঘেঁষে উঠে গেছে গোলাপি পাহাড়। গোলাপি রঙের এই পাহাড়টি লেকের পানিকে আরো মনোহর করে তুলেছে এখানে। এখানকার মাটির বেশ কদর রয়েছে। কাপ-পিরিচ, থালা ও বাসনকোসন বানাতে এ মাটি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক ইনসুলেটর বানাতেও এ মাটি কাজে আসে।

চীনামাটির পাহাড় দেখে ফেরার পথে পড়বে গারো পাহাড়। গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো-খাসিয়া পর্বতমালার একটি অংশ। এর কিছু অংশ ভারতের আসাম রাজ্য এবং বাংলাদেশের নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত। গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার। কিছুটা সামনে আসার পর বিজয়পুর বাজারের দেখা মিলবে। এখানে ছোটখাটো কিছু খাবার আর নানান প্রসাধনীর দোকান রয়েছে। পাশেই অবস্থিত কমলার বাগার বা টাওয়ার টিলা নামে পরিচিত পাহাড়। পাহাড়ের ওঠে কমলার দেখা আর পাইলাম না। মূলত স্থানটার নামই কমলার বাগান। আমি মনে করেছিলাম এখানে মনে হয় কমলা বাগানের অবস্থান। উপরে ওঠে দেখি একটি টাওয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। তাও আবার টাওয়ারে ওঠার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিচে নেমে এলে সামনেই চোখে পড়বে সেনাবাহিনী ক্যাম্প। সামনে রাস্তা অতিক্রম করা বারণ আছে। ডানপাশে এগিয়ে গেলে মিলবে সোমেশ্বরী নদীর অনেক অংশ। এখান থেকে ছোট ছোট নৌকাযোগে জিরোপয়েন্ট যাওয়া যায়। আমরা নদীর পাড় থেকেই দূর থেকে দেখা জিরোপয়েন্ট অবলোকন করে নিলাম। নদীতে কেউ কেউ মাছ ধরছেন আবার কেউ কেউ গোসলে ব্যস্ত। নদীর দুই ধারের দৃশ্যপটগুলো আকর্ষণীয়।

ফেরার পালা। ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে লালিমার আবরণ স্পষ্ট হচ্ছে। সোমেশ^রী নদী পার হয়ে দুটো অটোতে চেপে বসলাম পরবর্তী গন্তব্য কলমাকান্দার উদ্দেশে। কিছুটা এগোতেই দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো। দূর দিগন্তের পাখিরাও ফিরছে আপন নীড়ে। আমরাও ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কলমাকান্দায়। নামাজ আদায় করে আমরা স্থানীয় একটি গেস্ট হাউজে ওঠলাম। সংগঠনের স্থানীয় ভাইয়েরা আমাদের স্বাগত জানালো। সবাই ফ্রেশ হয়ে পাশেই অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। গরুর গোশতের জন্য রেস্টুরেন্টটি বিখ্যাত। সবাই তৃপ্তিসহকারে খেয়ে রাতের বিশ্রামে গেলাম।

ভোর রাত। ফজরের নামাজের সময়। পাশের রুমের সালাত সালাত শব্দে মনে হলো শিক্ষাজীবনের মেস কিংবা হলে আছি। কলেজ কিংবা বিশ^বিদ্যালয়ের লাইফে মেস বা হলগুলোতে সালাত সালাত শব্দে একটা জান্নাতি পরিবেশ সৃষ্টি হতো। যাই হোক, নামাজ আদায় করে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম সকালের নাশতা করতে। নাশতা শেষ করতেই গেস্ট হাউজের সামনে আগে থেকে ঠিক করা অটো দুটো হাজির। রওনা দিলাম কলমাকান্দা উপজেলার দর্শনীয় স্থান পাঁচগাঁওয়ের উদ্দেশে।

নরম রোদ সবে প্রখর হতে শুরু করেছে সকালটায়। তিন চাকার এ যান ছুটে চলছে পাহাড়ের লক্ষ্যপ্রাণে। পাহাড় বরাবরই আমাকে টানে। কলমাকান্দা উপজেলা থেকে ১১ কিলোমিটার পূব-উত্তরে গেলেই গন্তব্য, ছায়াঘেরা নয়নাভিরাম সবুজ এক পাহাড়ি গাঁও। যাত্রাপথে চায়ের বিরতি নিলাম। কেউ কেউ আবার স্থানীয় লোকজনদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলল। কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টির আলিঙ্গন। দু-চার মিনিটের বৃষ্টি আবার রোদ। মনে হলো, পরিবেশ আমাদের সাথে লুকোচুরি করছে। রাস্তার দুই ধারে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত। মাঝের রাস্তা কিছুটা ভোগান্তির। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। দূর দিগন্তে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো দৃশ্যমান হতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে চলে এলাম, সীমান্ত পাহাড়ের সেই গাঁও। পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরে সীমান্তের কাছাকাছি। একেবারে নীরব-নির্জন জায়গা। নির্জন সৌন্দর্য উপভোগ করছি পাহাড়ের। অন্য পাশে বিস্তীর্ণ ভূমি। এখানে যেন কোথাও কেউ নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখে আমার কাছে মনে হলো, পাঁচগাঁও কবিতার গাঁও, চুপচাপ বসে পাহাড় দেখার গাঁও। সবকিছ ুযেন ছবির মতো।

সামনে এগোতেই বিজিবির চেক পোস্ট। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে ৭টার আগে এলে যাওয়া যায়। ততক্ষণে বিজিবিরা চেক পোস্টে আসে না। দূর থেকেই থরে থরে সাজানো পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। সবাই তখন ছবি তুলতে ব্যস্ত। পাহাড় যেন আপন করে নিলো। ওই দিকে সীমান্তের ওপার হাতছানি দিয়ে ডাকছিল ভারতের মেঘালয়। তবে আমার কাছে গাঁয়ের রাস্তা ধরে কিছুটা দূর থেকে দেখা পাহাড়ের সৌন্দর্য বেশি নজর কেড়েছে। দূর থেকে দেখা মিললো পাঁচগাঁওয়ের আরেকটি দর্শনীয় স্থান চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়ের।

এবার ফেরার পালা। ফিরতে পথে কিছুটা ডানে মোড় নিলে মিলবে মহাদেব নদী। নদীর সৌন্দর্য আকর্ষণীয়। মেঘালয় থেকে নেমে আসার নদীর স্রোতে মন চাচ্ছে গা বিলিয়ে দেই। নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী সব নদীগুলোই আকর্ষণীয়। একেকটি নদী মনে হয় যেন রূপের পশরা সাজিয়েছে। ছোট ছোট নৌকা দিয়ে স্থানীয় লোকদের নদী পারাপারের দৃশ্যগুলো আরো সুন্দর। এসব রূপ দেখে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাটি মনে পড়ল- ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।’

পাঁচগাঁও থেকে ফেরার পথে মনে হলো আল্লাহর সৃষ্টির কী রহস্য? কোথাও নদী, কোথায় পাহাড় কিংবা কোথাও সমতল ভূমি। এজন্যই বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন, ‘ভ্রমণ স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য জানায়, ভ্রমণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। প্রত্যেক মানুষেরই সাধ্যানুসারে কাছে কিংবা দূরে ভ্রমণের মাধ্যমে স্রষ্টার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিকে দেখে অন্তরকে বিকশিত করা উচিত।’ ভ্রমণ সম্পর্কে আল্লাহ পাক সূরা আনকাবুতের ২০ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘বলে দাও, তোমরা ভূপৃষ্ঠে ভ্রমণ করো এবং দেখো, কিভাবে আল্লাহ প্রথমবারে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনি শেষবারেও সৃষ্টি করবেন।’