অর্থনীতির বৈদেশিক খাতে আশাব্যঞ্জক উন্নতি

অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরছে খেলাপি ঋণ

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ‘মিশ্র সঙ্কেতের’ মুখে। এক দিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা আশাব্যঞ্জক; অন্য দিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি গভীর চ্যালেঞ্জ। আর্থিক শৃঙ্খলা, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংক খাত সংস্কারে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অর্থনীতির চাপ আরো বাড়তে পারে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ অর্থনৈতিক সূচক (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) অনুযায়ী বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রফতানি ও ট্যাক্স আদায়সহ বেশ কিছু খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও ব্যাংকিং খাতের শ্রেণীকৃত ঋণ, শিল্পঋণ ও আমদানি ব্যয়ের চাপে সামগ্রিক অর্থনীতি এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ সাপ্তাহিক নির্বাচিত অর্থনৈতিক সূচক বলছে, কিছু সূচকে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও অন্যগুলোতে চাপ বাড়ছে। এক দিকে রেমিট্যান্স ও রফতানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে আস্থা ও আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণযোগ্য মাত্রায় আছে। অন্য দিকে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান শ্রেণীকৃত ঋণ, কম জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কট অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে।

সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। তবে রেমিট্যান্স ও রফতানি ইতিবাচক দিক। আর সরকারি ঋণনির্ভরতা ও সঞ্চয়পত্রের নেট বিক্রি ঋণাত্মক হওয়া রাজস্ব ঘাটতির ইঙ্গিত। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া বিনিয়োগ পরিবেশে চাপ সৃষ্টি করছে।

ক্রমাগত অবনতিশীল প্রবণতা পেরিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ওঠানামা এখন স্বাাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.৩৯ বিলিয়ন ডলারে, যা জুন ২০২৪-এ ছিল ১৯.৭ বিলিয়ন ডলার; অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। তবে বৃদ্ধির গতি এখন অনেকখানি থেমে গেছে।

রেমিট্যান্সের চিত্র অর্থনীতির জন্য বেশ ইতিবাচক। ২৪-এর বিপ্লবের পর থেকে রেমিটেন্স অর্থনীতিকে পতনের প্রবণতা থেকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। সেই প্রবাসী আয় এখনো শক্তিশালী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (প্রভিশনাল) হিসাবে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬.৮৩ শতাংশ বেশি। এটি রিজার্ভের চাপ লাঘব করছে। চলতি অর্থবছরেও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। জুলাই-আগস্ট এ দুই মাসে রেমিট্যান্সে ১৮.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

আমদানি চিত্রে দেখা যায় ২০২৫ অর্থবছরে ২.৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়ে মোট আমদানি ৬৮.৩৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। জুলাই ’২৫ মাসে আমদানি বৃদ্ধির হার অনেক বেড়েছে। এ সময়ে আমদানি বেড়েছে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২৫ অর্থবছরে রফতানি ৭.৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়ে ৪৩.৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে রফতানি বাড়ে ২৭ শতাংশেরও বেশি। এর প্রভাব পড়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে। চলতি হিসাবে জুলাই ’২৪ মাসে যেখানে ১৮১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল সেখানে জুলাই ’২৫ সালে এসে ১৪৯ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।

পুঁজিবাজারে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত আগের তিন মাসের তুলনায় ভালো অবস্থানে। এ সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক বেড়েছে ৭.৬৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সূচক বেড়েছে ৬.২০ শতাংশ। এতে পুঁজিবাজারে কিছুটা আস্থা ফিরেছে বলে মনে হচ্ছে।

ব্যাংক খাত ও ঋণ পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। সূচক অনুসারে মোট দেশীয় ঋণ জুলাই ২০২৫-এ গত বছরের তুলনায় ৭.৯৬ শতাংশ বেড়েছে। সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.৫১ শতাংশ, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় ৬.৫২ শতাংশ। ভয়ানক চিত্রটি হলো খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে। মার্চ ২০২৫-এ মোট খেলাপি ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ ছিল খেলাপি; নিট খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এক বছর আগে মোট খেলাপি ঋণের হার ছিল ১১ শতাংশে কিছু বেশি। ধারণা করা হচ্ছে সব ব্যাংক স্বচ্ছভাবে যদি নিয়মিত অনিয়মিত ঋণের হিসাব করে তাহলে সেপ্টেম্বর ’২৫ শেষে গ্রস খেলাপি ঋণ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে চলে যেতে পারে।

কৃষি, এসএমই ও শিল্পখাতের অবস্থা খুব একটা ইতিবাচক নয়; জুলাই ২০২৫-এ দুই হাজার ১৫৪ কোটি টাকা (জুলাই অর্থবছর ২৬-এর লক্ষ্য অর্জন ৫.৫২ শতাংশ) কৃষিঋণ বিতরণ হয়। এসএমই ঋণ বিতরণ হয় অর্থবছর ২৪-এ সর্বোচ্চ ৬৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা, অর্থবছর ২৫-এর প্রথম প্রান্তিকে তা কিছুটা কমেছে। শিল্পখাতের টার্ম লোন অর্থবছর ২৫-এ ৯৭ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা বিতরণ হয়, আদায় হয় এক লাখ সাত হাজার ২৯৭ কোটি টাকা; বকেয়া স্থিতি রয়েছে ৩.৮৯ লাখ কোটি টাকা।

জাতীয় সঞ্চয়পত্রের নেট বিক্রি ঋণাত্মক (ছয় হাজার ৬৩ কোটি টাকা) হলেও মোট স্থিতি ৩.৩৮ লাখ কোটি টাকা; অর্থাৎ সরকার জনসাধারণের কাছে নতুন ঋণ তুলতে পারছে না।

মূল্যস্ফীতি জাতীয় ভোক্তা মূল্যসূচক (২০২১-২২ ভিত্তি) অনুযায়ী জুলাই অর্থবছর ’২৬-এ মুদ্রাস্ফীতি ১২.২৮ শতাংশ। ১২ মাসের গড় ৯.৫৮ শতাংশ হলেও পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে এটি ৮.২৯ শতাংশ; অর্থাৎ সামগ্রিক চাপ এখনো বেশি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ‘মিশ্র সঙ্কেতের’ মুখে। এক দিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা আশাব্যঞ্জক; অন্য দিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি গভীর চ্যালেঞ্জ। আর্থিক শৃঙ্খলা, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংক খাত সংস্কারে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অর্থনীতির চাপ আরো বাড়তে পারে।