অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো কার্যকর ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গতকাল কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপে দেয়া বক্তব্যে এ আহ্বান জানান। খবর কক্সবাজার অফিস, বাসস, উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতি থামাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধানে যে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন, দাতাদের অব্যাহত সমর্থন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার আহ্বান, রোহিঙ্গাদের সাথে গঠনমূলক সংলাপ ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা, গণহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহিতা ত্বরান্বিত করা।
রোহিঙ্গা সঙ্কটকে বিশ্ব-সম্প্রদায়ের কাছে আরো জোরালোভাবে তুলে ধরতে গত রোববার থেকে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সংলাপ ‘স্টেকহোল্ডার্স’ ডায়ালগ : টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’। গতকাল স্থানীয় হোটেল বে ওয়াচে আয়োজিত এই সংলাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা।
উদ্বোধনী বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরে আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বেচ্ছায় এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্মভূমির সাথে তাদের নাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। এখন আর কেবল বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনই।’
এ ছাড়া তিনি দাতাদের ও মানবিক অংশীদারদের অব্যাহত সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছে আবেদন জানাই যাতে তারা তাদের অঙ্গীকার বাড়ায় এবং ২০২৫-২৬ সালের যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার তহবিল ঘাটতি পূরণ করে।’
একই সাথে তিনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে অপরিহার্য উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আসিয়ান ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে আরো সক্রিয়ভাবে রাখাইন ও পাশের অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে মানবপাচার, মাদক চোরাচালান ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের অবৈধ ব্যবসার মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনেও উদ্যোগী হতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা এবং এর টেকসই সমাধানকে বৈশ্বিক এজেন্ডায় রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। এই সংহতির চেতনায়, গত রমজান মাসে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এবং আমি কক্সবাজারে এক লাখ রোহিঙ্গার সাথে একত্রে ইফতার করেছি। আমরা স্পষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের আকুল ইচ্ছা শুনেছি- যত দ্রুত সম্ভব তারা তারা ঘরে ফিরে যেতে চায়।’
গত বছর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে তিন দফা প্রস্তাব উপস্থাপনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার আহ্বানকে স্বীকৃতি জানিয়ে এ বছরের সাধারণ পরিষদে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমি আশা করি, কক্সবাজারের এই সংলাপ নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে যথেষ্ট অবদান রাখবে এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানের রোডম্যাপ তৈরিতে সহায়ক হবে।’
অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে ২০১৭ সালের আগস্টের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই বর্বরোচিত আক্রমণ ও নিপীড়ন এখনো চলমান।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি বিশ্ব-সম্প্রদায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখ, যা কক্সবাজারকে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থীশিবিরে পরিণত করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘প্রতি বছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন শিশু রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিচ্ছে, অথচ মিয়ানমারে এখন পাঁচ লাখেরও কম রোহিঙ্গা রয়েছে। এটি প্রমাণ করে, চলমান নিপীড়নের কারণে তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দীর্ঘ আট বছরে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেও সতর্ক করে দেন যে, দেশীয় উৎস থেকে আর কোনো সম্পদ জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই সঙ্কট নিরসনে বৈশ্বিক সহযোগিতা এখন অত্যন্ত জরুরি।
তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কটের সূত্রপাত মিয়ানমার থেকে। সমাধানও সেখানেই নিহিত। সব পক্ষকে দ্রুততম সময়ে কঠিন দৃঢ়তার সাথে এই সঙ্কটের অবসান ঘটাতে হবে।’
রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস আশ্বাস দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ তাদের পাশে রয়েছে এবং তাদের মাতৃভূমিতে দ্রুত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য কাজ চালিয়ে যাবে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘চলুন আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে তাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনে অবদান রাখার অঙ্গীকার করি, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করি।’
অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, এর আগে সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস। সেখান থেকে তিনি সরাসরি সম্মেলনস্থল ‘হোটেল বে ওয়াচে’ যান এবং মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন।
‘টেক অ্যাওয়ে টু দ্যা হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্যা রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শীর্ষক এ তিন দিনের সম্মেলন রোববার (২৪ আগস্ট) শুরু হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রোহিঙ্গা ইস্যুবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দফতর যৌথভাবে এ আয়োজন করেছে। এতে অংশ নিচ্ছেন জাতিসঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয় সব স্টেকহোল্ডারসহ অন্তত ৪০টি দেশের প্রতিনিধি।
আজ মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) শেষ দিনে বিদেশী অতিথিরা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। সেখানে তারা সরাসরি বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে বর্তমান দুঃসহ জীবনের কথা শুনবেন। কূটনৈতিক মহল মনে করছে, উচ্চপর্যায়ের এই সম্মেলন থেকে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বা উদ্যোগ ঘোষিত হলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘ দিনের অচলাবস্থা নিরসনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, বীর প্রতীক, রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজু বক্তব্য রাখেন।
সংলাপে বিভিন্ন দেশের কুটনীতিক, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছেন।
দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এক বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর, বর্তমানে দেশ যথেষ্ট স্থিতিশীল এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তিনি জানান, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
প্রধান উপদেষ্টা গতকাল সোমবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছি। এক বছর আগে আমরা এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।’