ধনুয়া-ময়মনসিংহ গ্যাসলাইন
- পৌনে ৩ বছরে বাস্তব অগ্রগতি ৬১.৮০ শতাংশ
- প্রতি কিলোমিটার লাইনে নির্মাণব্যয় ৯০ লাখ টাকা
প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদ আছে আর মাত্র চার মাস। মেয়াদ ফুরিয়ে এলেও প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ হয়নি ময়মনসিংহ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য ধনুয়া থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে। ফলে পাইপলাইন নির্মাণকাজও শুরু করা যায়নি। পৌনে তিন বছরে অর্থাৎ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৬১.৮০ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় প্রধান কাজগুলোও হয়নি। ফলে ক্রয়কৃত মালামাল যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে মালামালের গুণগতমান নষ্ট হচ্ছে। আইএমইডির নিয়োগপ্রাপ্ত সংস্থা ফ্রামির ইঞ্জিনিয়ারিং বলছে, দুই বছর আট মাসে প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজগুলো না হওয়ায় খরচও হয়নি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে ২৩.২০ শতাংশ। ফলে নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্প সমাপ্ত হওয়া এবং ব্যয়বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের প্রকল্পের তথ্য বলছে, সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) জন্য বিভিন্ন ধরনের জ্বালানিভিত্তিক সর্বমোট দুই হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। ওই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ময়মনসিংহ এলাকায় অবস্থিত কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে সুলভমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয় সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘ময়মনসিংহ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য ধনুয়া হতে ময়মনসিংহ পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ’ শীর্ষক চলমান প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা করা হয়। গত ২০২২ সালের ১৯ জুলাই একনেক সভায় জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে তিন বছরে বাস্তবায়নে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫৩ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা (জিওবি ৪১৮ কোটি ৫৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ও নিজস্ব তহবিল ১৩৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা)। প্রকল্পটি রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও ডিপোজিটরি ওয়ার্ক হিসেবে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) বাস্তবায়নের দায়িত্বে।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, ৮৪.৭৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ভূমি অধিযাচন বা ২১৪.১৪ একর রিক্যুইজিশন, পাইপ ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি ক্রয়, ধনুয়া হতে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ২০” ব্যাস গুণ এক হাজার পিএসআইজি গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন, এইচডিডি পদ্ধতিতে নদী ক্রসিং, ইপিসি ভিত্তিতে টাউন বর্ডার স্টেশন এবং সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন (স্ক্যাডা) ও সিপি সিস্টেম স্থাপনসহ গ্যাস পাইপলাইনের আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ।
প্রকল্পের কাজের পর্যালোচনা : প্রকল্পের ডিপিপিতে ২০” ব্যাসের গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের অবমূল্যায়িত প্রাক্কলন। কারণ ডিপিপিতে ২০” ব্যাসের গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারা প্রকল্পের অন্যতম দুর্বল দিক। দরপত্র আহবান করার পর সর্বনি¤œ গ্রহণযোগ্য দরদাতার দর ডিপিপির প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়। পাইপলাইন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চুক্তিপত্র অনুযায়ী সব পণ্য সরবরাহ করেছে। এ ছাড়া পাইপলাইনগুলোর প্রকল্পের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। সাইট পরিদর্শনকালে কিছু পাইপের ফিজিক্যাল ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বেশির ভাগ পাইপের প্রান্তগুলো ক্যাপ এবং বেবেল প্রটেক্টরের মাধ্যমে সুরক্ষিত ছিল না। তা ছাড়া পাইপের ভিতরে মরিচা এবং অন্যান্য ফরেন পার্টিকেল উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। পাইপের ব্যাস, পুরুত্ব এবং দৈর্ঘ্য রেনডমলি পরিমাপ করা হয়েছে এবং পাইপের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনের সাথে কোনো গরমিল পরিলক্ষিত হয়নি। রেনডমলি পাইপের কোটিং এবং আবরণ পরিমাপ করা হয়েছে। পাইপের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনের সাথে কোনো গরমিল পরিলক্ষিত হয়নি। গুদামাগারে পাইপগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিধিমালা অনুযায়ী সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তা ছাড়া পাইপলাইনগুলোর ওপর কোনো কভার পরিলক্ষিত হয়নি। যার ফলে বৃষ্টি অথবা সূর্যালোকে পাইপের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রেনডমলি পাইপ তৈরির রেকর্ড (হিট নম্বর ও ব্যাচ নম্বর) চেক করা হয়েছে। পাইপের ডাটাশিটের সাথে কোনো গরমিল পরিলক্ষিত হয়নি।
অগ্রগতি পৌনে ৩ বছরে ৬১.৮০ শতাংশ : তিন বছরের প্রকল্প গত ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৪৮.৩৯ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৬১.৮০ শতাংশ। ডিপিপি অনুযায়ী ওই সময়কাল পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রা ৭৫ শতাংশ ও ভৌত অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৮৪.৭৩ একর। এর মধ্যে গাজীপুর জেলায় ৮.২ একর এবং ময়মনসিংহ জেলায় ৭৬.৫৩ একর। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলা এবং ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলা অংশের অধিগ্রহণতব্য ভূমির ৭-ধারা নোটিশ জারি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলা অংশের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৭-ধারা নোটিশ জারি করা হবে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলা অংশের জেলা প্রশাসক ময়মনসিংহ কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। যা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ৭-ধারায় নোটিশ জারি করা হবে। জিটিসিএল কর্তৃক পাইপলাইন নির্মাণসামগ্রী ক্রয়ের নিমিত্ত আটটি প্যাকেজ এর মধ্যে ০২টি প্যাকেজ (পণ্য-১, পণ্য-২) এর মালামাল স্থানীয় বাজার থেকে আরএফকিউ পদ্ধতিতে ক্রয়কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ছয়টি প্যাকেজের (পণ্য-৩, পণ্য-৪, পণ্য-৫, পণ্য-৬, পণ্য-৭, পণ্য-৮) চুক্তি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবানের মাধ্যমে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। কার্য ক্রয় সংক্রান্ত ০৮টি প্যাকেজের মধ্যে মাটি ও সাব-সুয়ারেজের কাজ (ডউ১) সম্পন্ন হয়েছে। তবে পাইপলাইন নির্মাণকাজ না হওয়ায় এর সাথে সম্পৃক্ত অনেক আইটেমের দরপত্র আহবান করা হয়নি। প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কোনো এক্সটার্নাল অডিট সম্পন্ন করা হয়নি। প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে এক্সটার্নাল অডিটের কাজ শুরু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণে আইএমইডির নিয়োগপ্রাপ্ত সংস্থা ফ্রামির ইঞ্জিনিয়ারিং বলছে, প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে, অনুমোদিত ডিপিপির ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রয়কাজ সম্পন্ন করতে না পারা, ডিপিপিতে ভূমি অধিগ্রহণ ও অধিযাচনের প্রাক্কলনে ত্রুটি বা ভুল থাকা, ডিপিপিতে ২০” ব্যাসের গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের অবমূল্যায়িত প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর দেশে গ্যাস ঘাটতির কারণে চাহিদামতো গ্যাস প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, সময়মতো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না হওয়ার কারণে প্রকল্প সমাপ্তির সময় বৃদ্ধির ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা, প্রকল্প এলাকায় মাছচাষিসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের কারণে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া, ক্রয়কৃত মালামাল যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে মালামালের গুণগতমান নষ্ট হওয়া।