সীমাহীন সমস্যার বেড়াজালে আটকে আছে দেশের নদ নদীর জীবন। দখল দূষণে ছোট হয়ে আসছে একের পর এক নদ-নদী। সেই সাথে ভাঙনে জমির পরিমাণ কমছে, সঙ্কটে পড়ছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং ভূমি ভাঙনের কারণে মানচিত্রের আকার ও আকৃতিতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে প্রবাহ স্বল্পতা, দখল, দূষণ, বালু-পাথর উত্তোলন ও ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকার চারপাশের চার নদী। যেগুলো এখন নামমাত্র বেঁচে আছে। এগুলো রক্ষায় দীর্ঘদিন নানান উদ্যোগের পরও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে এগুলোর জীবন রক্ষা এখন প্রায় অনিশ্চিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত। এর মধ্যে বড় বড় নদীগুলোর ভাঙনের তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। সীমান্ত নদীগুলোতে বাংলাদেশ এলাকার ভূমি ভারতীয় এলাকায় জেগে উঠছে। সেগুলো পার্শবর্তী দেশ তাদের দখলে নিচ্ছে। এমনি করে বিভিন্ন সীমান্তে দেশের মানচিত্র ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে।
এ ছাড়া বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী এবং অন্যান্য অনেক নদী দখলের কারণে সেগুলো ছোট হয়ে আসছে। নদীর তীরে অবৈধ নির্মাণ, বাসস্থান, শিল্পকারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে নদী সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। শিল্পকারখানা থেকে দূষিত পানি এবং আবর্জনা ফেলে নদী ভরাট করা হচ্ছে, যা নদীর প্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে। আবার কিছু নদী পানিপ্রবাহের গতিপথ হারিয়ে কোনোমতে বেঁছে আছে। ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগসহ নদী উদ্ধারে দফায় দফায় অভিযান চালানো হলেও এখন অনেকটা থেমে আছে সেই অভিযান কার্যক্রম। ফলে প্রভাবশালীদের অপতৎপরতা আর বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় দূষণে মরছে নদী।
একাধিক সংস্থার তথ্য বলছে, গত ৫০ বছরে দেশের নদনদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তালিকায় থাকা মোট ৩৮৩টি নদীর অনেকগুলোর অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন। দূষণ ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, আবাসনের ফলে ছোট-বড় আরো অনেক নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
অন্য দিকে শিল্প-কারখানার অপরিশোধন বর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্য, প্লাস্টিকসহ নানারকম অপচনশীল দ্রব্য নদীতে ফেলে দূষণ ছড়ানো হচ্ছে। এর বাইরে রয়েছে অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলন, চাষাবাদ ও মাছ ধরার জন্য নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে এর প্রবাহ সঙ্কুচিত করা। এগুলো রক্ষায় একাধিক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থাকলেও প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক শক্তির কারণে তাতে সফলতা আসে না।
বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী নদী দখলের মহোৎসবে মেতেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। নদীর বুকে অবৈধ মাছবাজার গড়ে তুলেছিলেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। কর্ণফুলী রক্ষার দায়িত্ব যে সংস্থার সেই বন্দর কর্তৃপক্ষও ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে ভরাট করে নদী ইজারা দিয়েছিল প্রভাবশালীদের। আর ‘তরফদী সাদী’ মিঠাপুকুরের যমুনেশ্বরী নদীর বালুমহাল থেকে সরকারিভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হতো নদীর বালুয়া রঘুনাথপুর থেকে। একই অবস্থা ছিল চাঁদপুরে। সাবেক মন্ত্রী দিপু মনির ছত্রছায়ায় তার আস্থাভাজন সেলিম চেয়ারম্যান বিগত সময়ে সেখানে নদী দখলের মহাযজ্ঞ চালিয়েছে।
অপর দিকে মেঘনা গ্রুপ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় মেঘনা নদীর শত শত বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়ে ২৫ শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। এই শিল্প কলকারখানা গড়তে গিয়ে বছরের পর বছর মেঘনা গ্রুপ মেঘনা নদীকে গ্রাস করেছে। কিন্তু এরা প্রভাবশালী হওয়াতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে দখল হওয়া নদ-নদী উদ্ধারের পরিবর্তে প্রাণ হারাতে বসেছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশে শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮ নদ-নদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে এখন মৃতপ্রায়। ৫৩ জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যদিও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মতে নদী দখলদারদের সংখ্যা আরো বেশি। নদী কমিশনের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে নদীখেকো ৪৭ হাজার। এরমধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জেই ১৯৮ দূষণকারী। ঢাকার টঙ্গী থেকে সদরঘাট হয়ে ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদ দূষণে জড়িত ১২০ প্রতিষ্ঠান। নারায়ণগঞ্জে নদী দূষণের তালিকায় রয়েছে ৭৪টি প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) (অতিরিক্ত সচিব) মো: আবুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, নদী দখল দূষণে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে ডিসিদের এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার নয়া দিগন্তকে বলেন, নদী হলো রাষ্ট্রের সম্পদ। কিন্তু এসব রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এজন্য দায়ী। তাই যারা চেয়ারে বসে নদী রক্ষার দায়িত্বে আছে তাদের বিরুদ্ধেও মামলা হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, নদ-নদীর দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ করাই এনআরসিসির প্রধান কাজ। কারণ দেশের নদ-নদীর অভিভাবক এনআরসিসি। কিন্তু এর মধ্যে সিএস ম্যাপের অজুহাতে ৩৭ হাজারের বেশি দখলদারের তথ্য মুছে দিয়ে তাদের দায়মুক্তি দিয়েছে এনআরসিসি। কমিশন এমন ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে থাকলে অল্পদিনের মাথায় দেশের বড় বড় নদীও মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাবে।