সততা

Printed Edition
সততা
সততা

ফরিদ উদ্দীন খান

সততা মানবচরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ। জীবনে সততার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বর্তমান সময়ে সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তা বলে অসম্ভব নয়! সততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন দুইজন ব্যবসায়ী যুবক। এমনই অবাক করা দুটি বিস্ময়কর ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আজ থেকে দুই বছর আগের কথা। রমজান মাসে খতম তারাবি পড়াচ্ছি। একদিন রাতের বেলা আমার এক মুসল্লির দোকানে গিয়েছিলাম একটি ইস্ত্রি কেনার জন্য।

সেখান থেকে শখ করে নিজের পছন্দসই একটি ইস্ত্রি কিনে আনি। সেটি সুন্দরভাবে টানা দুই বছর ব্যবহার করি। এতে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। আলহামদুলিল্লাহ।

গেলো সপ্তাহের কথা।

হঠাৎ করে আমার ইস্ত্রি সমস্যা দেখা দেয়। কোনোভাবেই এর সমস্যা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিদ্যুৎ লাইন আসতো না ইস্ত্রিতে। এরই মধ্যে আমি একদিন সময় করে ইলকট্রনিক্স দোকানে নিয়ে যাই। ইলকট্রনিক মেকারকে জিজ্ঞেস করলে মিটার দিয়ে চেক করে বলেন, ‘হুযুর, ২০০ টাকা লাগবে। এবং আমাকে একদিন সময় দিতে হবে’।

বললাম, ঠিক আছে। রেখে দিন।

তবে আমার কাছ থেকে একটু টাকা কম রাখবেন। ঠিক আছে! আমি এসে পরবর্তী সময়ে নিয়ে যাবো।

দু’দিন পর আমি তার সাথে ফোনালাপ করে দোকানে গেলাম। সেখানে গিয়ে এক অবাক করা দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম! আমি যেতেই ভাই হেসে দিলেন। ভেবেছি, নিশ্চয়ই আমার ইস্ত্রি তিনি ঠিক করতে পেরেছেন, তাই হাসছেন। আসলে বিষয় তা নয়!

বরং ভিন্ন একটি মজার ব্যাপার রয়েছে। তা হলো, তিনি তার কর্মচারীকে বললেন, ‘হুযুরের ইস্ত্রি চেক করে দাও’। সে ইস্ত্রির তার কারেন্টের ফাংশনে দিলেই বাতি জ্বলে ওঠে। আমি প্রচ খুশি হলাম। পকেট থেকে ১৪০ টাকা বের করে দিলাম। সে টাকা হাতে নিলো। নিয়ে বললো, ‘হুযুর ২০০ টাকা পুরিয়ে দিন।’

বললাম, রাখেন ভাই! আবার বললেন, দেন পুরাইয়া দেন। আমি আরো ১০ টাকা বের করে ৫০ টাকা পুরিয়ে দিলাম। তখনও সে সেই টাকা নিতে রাজি হলো না!

বরং সে সম্পূর্ণ টাকা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমি অবাক হলাম! ভাবলাম, তিনি বোধ হয় রাগ করছেন। তাই আমার টাকা নিচ্ছেন না। এর মানে তাকে পরিপূর্ণ ২০০ টাকা পুরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় সে নেবে না। আমি বারবার বলছিলাম, ‘রাখেন ভাই রাখেন। এবারের মতো রাখেন। এই তো প্রথমবার আসলাম। সামনে আবারো আসবো ইনশা আল্লাহ। আমাদের সাথে টাকা নিয়ে পীড়াপীড়ি করে কী লাভ! টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা নেবেন। আমরা কি টাকা কামাই করি’!

এসব কথা বলতে লাগলাম। এসব বলার পরও সে টাকা নিচ্ছেন না। বরং সম্পূর্ণ টাকা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। বলছেন, ‘টাকা হাতে নেন। এরপর বলছি। বললাম, ‘আপনার হাতে রেখেই বলেন’।

এর পরও সে মানছে না। শেষমেশ সে আমার হাতে টাকা ফিরিয়ে দিলো। এরপর বললো, ‘আপনাকে টাকা দিতে হবে না। কারণ, ইস্ত্রি ঠিক করার আগেই ভালো ছিল। আমাকে কোনো কাজ করতে হয়নি। তাই আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আমি তো অবাক, কী বলছেন এসব! যেই মানুষটি গতো দু’দিন আগে তার মিটারে চেক করে বললেন যে, আপনাকে ঠিক করাতে ২০০ টাকা দিতে হবে।

তেমন বড় কোনো সমস্যা নেই। তবে আমাকে ঠিক করতে দু’দিন সময় দিতে হবে। সেই মানুষটিই আজকে কিনা বলছে, আপনার ইস্ত্রি ঠিক করতে হয় নাই। আমি আপনার কাছ থেকে টাকা নেবো কেন’?

সে চাইলে বিষয়টি গোপন রেখে আমার কাছ থেকে সম্পূর্ণ টাকা নিতে পারতো! তা কিন্তু করেনি।

বরং সে উদারতা এবং সততার পরিচয় দিয়েছে।

বললাম, আপনার সততায় আমি মুগ্ধ!

আপনাকে আমি এই টাকা দিয়ে দিলাম!

সে নিতে রাজি নন। বললেন, ‘নাহ্, হুযুর নিয়ে যান। সমস্যা নাই’। বললাম, ‘আমি আপনাকে চা খেতে দিলাম’। এতেও তিনি নিতে রাজি নন।

শেষমেশ বললাম, ভাই, আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভ কামনা রইল। আপনার আচরণে আমি মুগ্ধ! এ কথা বলে সেখান থেকে চলে আসলাম।

এসে আখের গুড় কিনতে আরেক দোকানে গেলাম। সেখানে আরো একটি অবাক করা ঘটনা ঘটে গেলো। সে ঘটনাটিও আমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করেছে। কারণ, আমরা ভাবি ভালো মানুষ বোধ হয় দুনিয়ার বুক থেকে চলে গেছেন। খারাপ মানুষে ভরে গেছে জগৎ। বিষয়টা এমন নয়। বরং সম্পূর্ণই ভিন্ন। তারই বাস্তবতা আজকের দুটি ঘটনা। যা আমাদেরকে ভালো মানুষের যথেষ্ট উপস্থিতির জানান দিয়েছে। ঘটনাটি হলো-

আমি গুড় বিক্রেতার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আখের গুড় কত করে কেজি? বললেন, ‘১২০ টাকা’।

আমি ভেবেচিন্তে বললাম, ‘চাচা, আমাকে আদা কেজি আখের গুড় দেন। তিনি আমাকে আদা কেজি গুড় দিলেন। আমি পকেট থেকে টাকা বের করে এক কেজি গুড়ের দাম ১২০ টাকা দিলাম। তিনি চাইলে এই টাকা নিয়ে নিতে পারতেন। তা তিনি করেননি। বরং বললেন, ‘আপনি আমাকে বেশি টাকা দিছেন’!

বললাম, কি বলেন!

বললেন, ১২০ টাকা দিছেন আপনি!

এরপর আমি ভুল বুঝতে পারলাম যে, আমি আদা কেজি গুড় নিয়ে এক কেজির দাম দিয়ে দিছি। আমি তাকে শুকরিয়া ও মোবারকবাদ জানিয়ে টাকা নিয়ে ফেরত আসলাম। এই ছিল আজকের সৎ লোকের দুটি ঘটনা। যা আমাদেরকে সততার সাথে জীবনযাপনের সবক শেখায়। আসুন আমরা সৎ ও সততার সাথে জীবনযাপন করার প্রত্যয় গ্রহণ করি।