এবারো হতাশা চামড়া নিয়ে

নির্দিষ্ট দামে বিক্রি হয়নি ৯০ শতাংশ পশুর চামড়া

মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে তারা সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন আর ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেছেন ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায়।

শাহ আলম নুর
Printed Edition

আগের বছরগুলোর মতো এবারো ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যাপক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রাজধানীতে চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তার প্রভাব পড়েনি বাস্তবে। অন্যান্য বারের মতো এবারো কম দামে গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়নি ৯০ শতাংশ চামড়া। আবার অনেকে ভালো দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে তা রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতি পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার এবার ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ৬০-৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। অনেক স্থানেই ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়নি এবং তা রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছে। প্রতি বর্গফুট গরুর চমড়ার দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বিক্রি হয়েছে গতবারের মতোই ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্গফুটের হিসাবে দাম আরো কম পড়েছে।

মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে তারা সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন আর ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেছেন ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায়। উত্তরার একজন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, ৭৫০ টাকায় চামড়া সংগ্রহ করে রীতিমতো বিপদে পড়তে হয়েছে। এই এলাকায় ভালো মানের চামড়ার দাম উঠেছে সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ৮২০ টাকা। এর ওপরে কোনোভাবেই চামড়া বিক্রি করা যায়নি। বাড্ডায় অপর এক চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, কাঁচাচামড়ার চাহিদা এবারো তলানিতে। ভালো দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেনি। একটি ভ্যান এবং দুইজন লেবার নিয়ে যে খরচ হয়েছে তার তুলনায় মুনাফা হয়নি বললেই চলে। সারা দিনের কষ্ট বৃথা গেছে। খিলক্ষেতের রহমত আলী বলেন, আগে জানলে এত দাম দিয়ে চামড়া কিনতাম না। প্রতিবারই ট্যানারি মালিকরা চামড়ার দাম দিতে অনাগ্রহ দেখায়। এতে আমাদের মধ্যেও দাম দিয়ে চামড়া কেনার প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

এ দিকে চামড়া সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরিত হওয়ার পর ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ছাগলের চামড়ার আকার ছোট এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচ বেশি হওয়ায় ট্যানারিগুলো এতে আগ্রহ হারিয়েছে। এক তথ্যে দেখা যায়, সরকার এবারের ঈদুল আজহায় পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। মাত্র ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ মানুষ নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছেন। গত ২৬ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০-৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। এদিকে ঢাকায় সর্বনি¤œ কাঁচাচামড়ার দাম এক হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ঢাকার বাইরের সর্বনি¤œ দাম নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ১৫০ টাকা। খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২-২৭ টাকা ও বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গরুর চামড়া আকারভেদে ২০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অনেক এলাকায়ই ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়নি। বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই রাস্তায় ছাগলের চামড়া ফেলে দিয়েছেন। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ চামড়া আসে লালবাগের পোস্তায়। ঈদের দিন বিকেল থেকেই রাজধানী ও আশপাশ এলাকা থেকে চামড়া আসতে শুরু করে পোস্তায়। ছোট ট্রাক, ভ্যানগাড়ি ও বিভিন্ন যানবাহনে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের সাথে মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চামড়া নিয়ে যান সেখানে।

এবার আড়তদাররা গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে কিনেছেন। ছোট গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি ও বড় আকারের গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়। আড়তদাররা দাবি করেন, শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রতিটি চামড়ায় সরকার নির্ধারিত এক হাজার ৩০০ টাকার মতো খরচ হয়। আরাফাত লেদারের কর্ণধার মোহাম্মদ জিবলু বলেন, তারা সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দামে চামড়া কিনেছেন। তিনি বলেন, চামড়া গোডাউনে ঢোকানো, লবণ লাগানোসহ সব কাজে খরচ আছে কমপক্ষে ৪০০ টাকা। হাজী ট্রেডিং করপোরেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, চামড়ার আকার অনুযায়ী দাম কম-বেশি হচ্ছে। তিনি জানান, এবার চামড়া বেশির ভাগই সাভার শিল্প নগরীতে চলে যাচ্ছে।

এছাড়া রাজধানী ও আশপাশ এলাকার কোরবানির পশুর চামড়ার একটি বড় অংশ আমিনবাজারে কেনাবেচা হয়। এখানে এবার বড় গরুর চামড়া ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ছাগল ও ভেড়ার চামড়ার চাহিদা একেবারেই ছিল না। আড়তদাররা ছাগল ও ভেড়ার চামড়া কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এসব চামড়া বাজার সংলগ্ন সড়ক ও ফুটপাথে ফেলে দিয়েছেন। আমিনবাজারে ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে আসা মাকসুদ আলম বলেন, ছাগলের চামড়া কেউ নিচ্ছে না। এত দূর থেকে ছাগলের চামড়া এনে বিপদে পড়েছেন বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাদাত উল্লাহ বলেন, ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে যখন ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরিত হয়, তখন ছাগলের চামড়া নিয়ে যারা কাজ করে তারা স্থানান্তর হতে পারেননি। এখন যে ট্যানারিগুলো আছে সেগুলোর ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা নেই। তিনি ছাগলের চামড়ার সমস্যা তুলে ধরে বলেন, ছাগলের চামড়া আকারে ছোট, প্রক্রিয়াজাতে খরচ বেশিসহ সমস্যা রয়েছে। এ কারণে ছাগলের চামড়ার প্রতি অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে ঈদের পরের দিন গত রোববার পশুর চামড়া বিক্রি পরিস্থিতি দেখতে পোস্তায় যান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। নির্ধারিত দাম কার্যকরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ দল কাজ করছে। তিনি বলেন, আমরা যে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছিলাম সেটি ছিল লবণসহ দাম। যেসব চামড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা যেটা বিক্রি হচ্ছে সেটি লবণ ছাড়া বলে তিনি জানান।

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম পাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা অসত্য। তিনি আরো বলেন, কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী যাদের চামড়া সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা নেই, তারা চামড়া নষ্ট করে ফেলছে। তিনি বলেন, চামড়া সংরক্ষণ উপযোগী ও মজুদ উপযোগী করার জন্য সরকার স্থানীয়ভাবে মজুদ ও লবণ দেয়াকে উৎসাহিত করছে। এর ফলে বাজার ব্যবস্থাপনায় স্থিতি ও চাহিদা-সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, মাঠপর্যায়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন চামড়া ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে। জাতীয় পর্যায়ে একটি কন্ট্রোল রুম করা হয়েছে, যেখানে ২৪ ঘণ্টা চামড়া ব্যবস্থাপনা মনিটরিং হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চামড়ার উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে, যেটি লবণ দেয়া চামড়া। সরকার নির্ধারিত মূল্যেই সেটা বিক্রি হচ্ছে বলেন তিনি জানান। উপদেষ্টা বলেন, সরকার সক্ষমতা তৈরির জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এ কাজে সহযোগিতা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। লবণ লাগিয়ে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে উপযুক্ত দাম চান, আশা করি উপযুক্ত দামই পাবেন। সরকার চাহিদা তৈরির জন্য কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। প্রণোদনার ২২০ কোটি টাকা ছাড় করিয়েছে। সারা দেশের প্রত্যেক জেলা, উপজেলা ও গ্রামে মসজিদে মসজিদে লবণ পৌঁছে দিয়েছে বলে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান।

চট্টগ্রামে নির্ধারিত দামের অর্ধেকও পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও লবণের মূল্য কম থাকায় এবার আড়তে ভালো দাম পাওয়ার আশা ছিল মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। কিন্তু আাড়তে বিক্রি করতে এসে হতাশ মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। বিগত বছরগুলোর মতোই বিক্রি হয়েছে নামমাত্র দামে। সরকার নির্ধারিত দামের অর্ধেকও পাননি অধিকাংশ বিক্রেতা। ফলে চট্টগ্রামে এখনো আওয়ামী আমলের চামড়া সিন্ডিকেট সক্রিয় কি না সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

গত শনিবার ঈদের দিন কোরবানির পরই কাঁচা চামড়া সংগ্রহে নেমে পড়েন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। দুপুরের পর থেকে তারা সংগ্রহ করা চামড়া নিয়ে নগরীর আতুরার ডিপো এলাকার আড়তে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে রীতিমতো হতাশ হন বিক্রেতা। তারা জানান, ৭০০-৮০০ টাকা দিয়ে প্রতিটি চামড়া কিনে আড়তদারদের কাছে নিয়ে গেলে তারা অনেক ভালো চামড়াও ৫০০ টাকার উপরে কিনছেন না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরদামে সময়ক্ষেপণ করা হয় কিংবা কিনতে অনাগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এভাবেই আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বিপুল পরিমাণ চামড়া অতি কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। আবু তাহের নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, চামড়ার দাম ঠিক করে দিয়ে সরকার দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে। পাটের ব্যবসার মতো চামড়া ব্যবসাও এক দিন হারিয়ে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকার আন্তরিক না হলে চামড়া ব্যবসা টিকবে না।

২০১৯ সালের আগেও একটি মাঝারি সাইজের কোরবানির গরুর চামড়া প্রায় তিন হাজার হাজার পর্যন্ত দামে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কিনে নিতেন। আর সেই টাকা যেত কোরবানির বিধান অনুযায়ী গরিব মানুষের পকেটে। আওয়ামী আমলে সিন্ডিকেট করে সেই চামড়ার ক্রেতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়েছিল প্রতিবেশী দেশকে সুবিধা দিতে। যদিও এবারের কোরবানির আগে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে আশ্বস্ত হয়ে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীই চামড়া সংগ্রহে নামেন। মৌসুমি ব্যবসায়ী মনজু মিয়া গড়ে ৬০০ টাকা দরে ২২টি বড় আকারের চামড়া কিনেন। কিন্তু আড়তে সেই চামড়ার দাম ৪০০ টাকা ছাড়ায়নি।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো: মুসলিম উদ্দিন বলেন, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে এক হাজার ১৫০ টাকা। একটি ২০ ফুটের চামড়ায় লবন দেয়া, পরিবহন খরচ, আড়তের খরচ সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ টাকা খরচ পড়ে। তা ছাড়া ট্যানারি মালিকরা প্রতি চামড়ায় ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে দেন। প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ বাদ দিয়েই লবণ ছাড়া চামড়ার দাম হিসাব করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তিনি দাবি করেন, বড় সাইজের গরুর চামড়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ৬০০-৭০০ টাকা দরে কেনা হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজের গরুর চামড়া ৩০০-৪০০ টাকা দরে কেনা হয়েছে। তিনি জানান, আমরা গরু জবাইয়ের ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যে আড়তে চামড়া পৌঁছানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকেই দেরিতে চামড়া পৌঁছানোর কারণে চামড়ার গুণগতমান নষ্ট হয়েছে। ফলে সেসব চামড়ার দাম অবশ্যই কম পাবে। এ বছর চট্টগ্রামের আড়তদাররা চার লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন বলে তিনি জানান।

মিরসরাইয়ে পানির দরে বিক্রি

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, প্রতি বছর ২০০-১০০ টাকায় কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে থাকি, এবার তো কেউ কিনতেই এলো না। পরে বাধ্য হয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। কথাগুলো বলেন মিরসরাই উপজেলার ডোমখালী এলাকার সাদেক হোসেন। তিনি বলেন, শুধু আমি নয়, আমার এলাকার অনেকে পশু চামড়া বিক্রি করতে পারেনি। ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর এলাকার বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী মফিজুর রহমান বলেন, গরুর চামড়া নিয়ে অনেক অপেক্ষা করেছি, কেউ নিতে আসে কি না। সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ নিতে না আসায় পরে গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছি।

জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভায় কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে মানুষ এবারো বিপাকে পড়তে হয়েছে। বলতে গেলে পানির দরেই বিক্রি হয়েছে পশুর চামড়া। গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা হয়েছে। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। উপজেলার করেরহাট ইউনিয়ন অলিনগর এলাকার নবী উল্লাহ জানান, তিনি এক লাখ ৭০ হাজার টাকা দামের গরু দিয়ে কোরবানি দিয়েছেন। তিনি গরুর চামড়া বিক্রি করেছেন মাত্র ২৫০ টাকায়। এ দিকে চামড়া কিনে লোকসানে পড়েছেন মিরসরাই উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন দুই পৌরসভার শত শত মৌসুমি ব্যবসায়ী। বড়তাকিয়া বাজারের চামড়া ব্যবসায়ী নুর উদ্দিন জানান, তিনি প্রায় ৬০০ চামড়া কিনেছেন। প্রতি পিস চামড়া ১০০-৩০০ টাকা দরে কিনেছেন। তার সবগুলো চামড়াতে শ্রমিক দিয়ে লবণ দিতে হয়েছে। এতে পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের পারিশ্রমিকের কারণে চামড়ার ক্রয়মূল্য বেড়ে গেছে।

বগুড়ায় এবারো বঞ্চিত গরিব দুস্থরা

বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ায় সরকার নির্ধারিত দামে এবারো চামড়া বিক্রি হয়নি। এতে স্থানীয় মাদরাসা, মসজিদ ও গরিব-দুস্থরা দান থেকে এবারো বঞ্চিত হলো।

বগুড়া সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী সিন্ডিকেটের বিদায়ের পর এবার নতুন সিন্ডিকেট চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বগুড়া শহরের কিছু স্থানে কেনাবেচা হলেও গ্রামাঞ্চলের অনেক স্থানে চামড়ার ক্রেতা ছিল না। গরুর চামড়ার চাহিদা থাকলেও সবচেয়ে খারাপ অবস্থা খাসি ও ভেড়ার চামড়ার। খাসির চামড়া কিছু স্থানে সর্বনিম্ন ৫ টাকায় বিক্রি হলেও অনেক জায়গায় এসব চামড়া কেউ কিনছেই না।

গাবতলীর লাঠিগঞ্জ গ্রামের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সায়েদ আলী গ্রাম থেকে বেশ কয়েকটি গরু ও ছাগলের চামড়া ভ্যানে করে বগুড়া শহরে নিয়ে আসেন। বেলা ২টা পর্যন্ত কোনো চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। তিনি বলেন, কেউ দামও বলে না। ছাগলের চামড়া তো কেউ নিতেই চায় না। বিকেলের দিকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় বিক্রি করতে পারছেন না। বগুড়া সদরের ঘোলাগাড়ি গ্রামের আবদুল মজিদ প্রামাণিক বলেন, ‘আমার ৯৬ হাজার টাকার গরুর চামড়া এখনো বাড়িতেই পড়ে আছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ কিনতে আসেনি। শুধু আমার না, গ্রামে অসংখ্য চামড়া অবিক্রীত।’

জানা গেছে, গরুর চামড়া আকারভেদে ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হলেও বেশির ভাগ চামড়া ৫০০ থেকে ৭০০ টাকাতেই কেনাবেচা হয়। খাসির চামড়া সর্বনিম্ন ৫ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দাম ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে।

স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহন ব্যয়, লবণ, মজুদ সুবিধার ঘাটতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চামড়া ব্যবসায়ী জুয়েল রানা বলেন, চামড়া সংরক্ষণের খরচ, পরিবহন খরচ মিলিয়ে ব্যবসা আর টিকছে না। বছরের এই একটা মৌসুমে ব্যবসা করি, এবার লাভ তো করতেই পারিনি, উল্টো ক্ষতিতে পড়েছি।

পাচারের অভিযোগ দিনাজপুরের ব্যবসায়ীদের

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে রাস্তায় বসেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা বেশি দামে চামড়া কিনলেও পাইকাররা তাদের কাছে ন্যায্যমূল্যে কেনেনি। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হন। আর চামড়া ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলছেন, চামড়া ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে। যে কারণে আশানুরূপ দাম পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বড় আকারের গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। ছোট চামড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে ক্রয় করেন। এ দিকে খাসির চামড়া বিক্রি করতে না পেরে বাজারেই ফেলে গেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে কাঁচা চামড়াগুলো। সোমবারও দিনাজপুরের রামনগর চামড়া বাজারে রাস্তার দুই ধারে স্তূপ আকারে ছাগলের চামড়া পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

দিনাজপুরের একমাত্র চামড়ার মোকাম দিনাজপুর সদরের রামনগর চামড়ার বাজারে ঈদের দিন সকাল থেকেই চামড়া কেনা-বেচা শুরু হয়। চামড়া বিক্রি করতে এসে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। কেনা দাম না পেয়ে লোকসান করে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সদস্য সচিব মোহাম্মদ আলী অভিযোগ করেন, দিনাজপুরের পুলহাট হয়ে কোরবানির চামড়া ঠাকুরগাঁও হয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার চামড়ার আমদানি অনেক কম। অনেক চামড়া ব্যবসায়ী আবার ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া টাকা না পাওয়ায় চামড়া কেনা-বেচায় সমস্যা হচ্ছে বলে জানালেন। দিনাজপুর চামড়া মালিক গ্রুপের সভাপতি আখতার হোসেন জানান, রামনগর এই চামড়ার বাজারে আগে এক থেকে দেড় লাখ পিস চামড়া কেনা-বেচা হতো। এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার পিস। তিনি বলেন, ট্যানারি গ্রুপের সিন্ডিকেটের কারণে জেলাপর্যায়ের চামড়া ব্যবসায়ীরা অর্থাৎ আড়তদাররা সব সময় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছেন। ট্যানারি মালিকরা বিপুল অঙ্কের টাকা বকেয়া রেখেছে। এই টাকা তারা ইচ্ছামতো পরিশোধ করছে। ফলে জেলাপর্যায়ের আড়তদাররা ইচ্ছা থাকলেও ঠিকমতো চামড়া ক্রয় করতে পারেন না।

সাভারে ট্যানারিতে ব্যস্ত শ্রমিক-মালিক

সাভার (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, সাভারের বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি শ্রমিক আর মালিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কোরবানি ঈদের দিন দুপুর থেকে চামড়া ঢুকতে শুরু করলে তাদের কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণের কার্যক্রম চলছে। গতকাল মঙ্গলবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিন লাখ ৭৮ হাজার পিস চামড়া এসেছে শিল্পনগরীতে। শ্রমিকরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দিন-রাত পরিশ্রম করে চলছে। এ দিকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয় না করার অভিযোগ উঠেছে ট্যানারি মালিকদের বিরুদ্ধে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এ বছরও দাম নিয়ে তাদের হতাশার কথা বলেছেন।

জানা যায়, সাভারে বিসিক শিল্পনগরীতে ঈদের দিন দুপুর থেকে ট্যানারিগুলোতে আসে কাঁচা চামড়া। ঈদের দিন দুপুরের পর এবং পরদিন রোববার যে পরিমাণে কাঁচা চামড়া ট্যানারিগুলোতে আসে পরবর্তীতে কিছুটা কম আসছে। কারণ মৌসুমি ব্যবসায়ী অনেকে কাঁচা চামড়াতে লবণ দিয়ে রাখছেন। ট্যানারি শ্রমিকরা বলছেন, কোরবানির ঈদে অনেক ব্যস্ততা থাকে তাদের। চামড়ায় লবণ লাগানোর কাজে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকরা প্রতিটি চামড়ার জন্য ৪০-৫০ টাকা দেয়া হয়। ঈদের মধ্যে দিন-রাত কাজ করতে হয়। পরিবারের সাথে ঈদ করতে সম্ভব হয়নি, খারাপ লাগে। আবার শ্রমিকরা বলছেন সবাই মিলে কাজ করার আনন্দও আছে।

এ দিকে বিভিন্ন মাদরাসার পক্ষ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা এবং অন্যান্য মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সরকার সর্বনিম্ন গরুর কাঁচা চামড়ার দাম এক হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করেছে। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ১৫০ টাকা। সেখানে ট্যানারি মালিকরা তাদের কাছ থেকে ৮০০ টাকা ক্রয় করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম দামে কিনছেন। সূত্র জানায়, সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে ১৪০টি কারখানায় এ বছর ঈদের দিন ও পরের দিন মিলিয়ে এক কোটির ও বেশি চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রতিটি কারখানা ও আড়তে আমদানি করা হয়েছে পর্যাপ্ত লবণ ও রাসায়নিক দ্রব্য।

সালমা ট্যানারির মালিক সাখাওয়াত উল্লাহ নয়া দিগন্তকে জানান, সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে গরুর কাঁচা চামড়া (লবণ ছাড়া) তিন লাখ ৭৮ পিস। আর ছাগলের ২০-২৫ হাজার পিস সংগ্রহ করা হয়। তিনি বলেন, গরুর কাঁচা চামড়া (লবণ ছাড়া) গড়ে ৭০০ টাকা থেকে ১০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যে ক্রয় করেন তারা। তিনি আরো জানান, লবণযুক্ত কাঁচা চামড়াগুলো ২-১ দিন পর থেকে আসা শুরু হবে। নিয়মতান্ত্রিক লবণ দেয়া হলে তিন মাস পর্যন্ত কাঁচা চামড়া ভালো থাকবে।