উন্নয়ন নাকি উচ্চমূল্যের ফাঁদ?

পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘সীমান্ত সড়ক’ প্রকল্পে দর পুনর্নির্ধারণ

সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো স্মারকের শর্তাবলি, তা হলো এই দর অন্য কোনো প্রকল্পে ব্যবহার করা যাবে না। এটিকে ‘নজির’ হিসেবে ধরা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি রেড ফ্ল্যাগ। কারণ সাধারণ সরকারি প্রকল্পে দরতালিকা জাতীয় পর্যায়ে একীভূত হয়। কিন্তু এখানে আলাদা করে বলা হচ্ছে- এই দর অন্য কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী তিন জেলা- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ‘সীমান্ত সড়ক নির্মাণ (২য় পর্যায়)’ প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রীর হঠাৎ উচ্চমূল্য নির্ধারণ ঘিরে তৈরি হয়েছে ব্যাপক প্রশ্ন। প্রকল্পটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের চূড়ান্ত ধাপে না পৌঁছালেও আগাম দর পুনর্নির্ধারণ এবং তাতে ‘নজির হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না’ শর্ত যোগ করায় স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

বাংলাদেশের কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল তিন পার্বত্য জেলায় নির্মাণাধীন ‘সীমান্ত সড়ক প্রকল্প (২য় পর্যায়)’ নতুন করে আলোচনায় এসেছে প্রকল্পটির নির্মাণসামগ্রীর দর পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত একটি গোপনীয় ধাঁচের সরকারি আদেশ ফাঁস হওয়ার পর।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে গত ১৮ নভেম্বর জারি করা এক স্মারকে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রীর দাম নতুন করে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে এই দর পুনর্নির্ধারণকে ঘিরে দেখা দিয়েছে একাধিক প্রশ্ন : এই দাম কি বাস্তব বাজারদরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? নিরাপত্তা ঝুঁকির আড়ালে কি অতিরিক্ত ব্যয়ের পথ খুলে দেয়া হয়েছে? নাকি এটি একটি বড় অবকাঠামো-দুর্নীতির অংশ?

প্রকল্পটির পটভূমি : এই প্রকল্পটি ‘অননুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প’ হিসেবে প্রস্তাবিত, অর্থাৎ এখনো জাতীয় পর্যায়ে পূর্ণ অনুমোদনের চূড়ান্ত ধাপে না পৌঁছালেও নির্মাণসামগ্রীর দর আগাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এটিকে একটি অস্বাভাবিক প্রশাসনিক ধারা হিসেবে দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

দর পুনর্নির্ধারণে অস্বাভাবিক মূল্য : সরকারি নথি অনুযায়ী বিভিন্ন সেগমেন্টে বালু, পাথর, ইট, সিমেন্ট, এমএস রড ও বিটুমিনের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।

কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্র : সিমেন্ট সরকারি অনুমোদিত দর প্রতি ব্যাগ ৮৩০ টাকা পর্যন্ত, এমএস রড প্রতি টন ৯৭,০০০-১,০২,০০০ টাকা, বালু সিএফটি প্রতি ১৮৮-৩৪৬ টাকা, পাথর সিএফটি প্রতি ২৮৫-৪৬২ টাকা প্রতিটি ইট ৩৫ টাকা পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন করছেন, একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে ‘ব্যাগ প্রতি সিমেন্ট ৮০০ টাকার উপরে’ দাম কিভাবে সম্ভব? এখানে ‘ইউনিট কনফিউশন’, অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় দেখানো, অথবা দাম ফুলিয়ে দেখানোর ঝুঁকি প্রকট বলে মনে করছেন প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

‘এই দর নজির হবে না’- কেন এমন শর্ত : সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো স্মারকের শর্তাবলি : এই দর অন্য কোনো প্রকল্পে ব্যবহার করা যাবে না। এটিকে ‘নজির’ হিসেবে ধরা যাবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি রেড ফ্ল্যাগ। কারণ সাধারণ সরকারি প্রকল্পে দরতালিকা জাতীয় পর্যায়ে একীভূত হয়। কিন্তু এখানে আলাদা করে বলা হচ্ছে- এই দর অন্য কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

প্রশ্ন উঠেছে : তাহলে কি এই প্রকল্পের জন্য আলাদা ‘প্রিমিয়াম’ বাজার তৈরি করা হচ্ছে? নাকি ভবিষ্যতে দর তফসিল তদন্তের বাইরে রাখতে একটি আইনি দেয়াল বানানো হচ্ছে?

পরিবহন ব্যয় : অদৃশ্য অতিরিক্ত বিলের ফাঁদ : নথিতে বলা হয়েছে- এই দরের মধ্যে পরিবহন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলের প্রকল্পগুলোতে ‘পরিবহন ব্যয়’ দ্বিতীয়বার ওঠে- ভারের মাধ্যমে, সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে, নকল বিলের মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষায় : ‘একবার পরিবহন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত, আবার আলাদা করে পরিবহন বিল- এটাই সবচেয়ে পরিচিত দুর্নীতির কৌশল।’

শ্রমিক মজুরিতে নিম্নহার, কিন্তু বাজেট ফুলে যায় কেন : শ্রমিকদের জন্য সরকারিভাবে অনুমোদিত মজুরি হার : সাধারণ শ্রমিক : ৬৪০ টাকা/দিন, দক্ষ শ্রমিক : ৭৪০ টাকা/দিন, ওয়েল্ডার : ৯৯০ টাকা/দিন। এখানে মজুরি ১১৪০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।

এই হার বাস্তবতার তুলনায় কম হলেও প্রকল্প ব্যয়ে ‘লেবার কস্ট’ দেখানো হয় অস্বাভাবিকভাবে বেশি- এ বিষয়টি বহু আগের দুর্নীতির প্যাটার্ন।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা কম শ্রমিক, বেশি উপস্থিতির রেকর্ড, ভুয়া হাজিরা, ভুয়া বিল আসার পথ তৈরি হতে পারে এখানে।

বড় প্রশ্ন কেন এত গোপনীয়তা : এই প্রকল্পের অস্বাভাবিক দিকগুলো : এখনো এটি ‘অননুমোদিত প্রকল্প’; কিন্তু দরের অনুমোদন আগেই ‘নজির হিসেবে ব্যবহার নয়’- এমন শর্ত দেয়া হয়েছে পার্বত্য অঞ্চল- নিরাপত্তা সংবেদনশীল এলাকা যুক্তি দেখিয়ে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি হতে পারে সামরিক-কৌশলগত প্রকল্পের আড়ালে বেসরকারি ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের প্রবেশ অথবা বিশেষ কিছু ঠিকাদারি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে বিশেষ দরকাঠামো।

রাষ্ট্রের সম্পদ না সিন্ডিকেটের স্বর্ণখনি : এই ধরনের প্রকল্প রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। কারণ সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা যুক্তিযুক্ত কিন্তু যেভাবে বাজেট, দর এবং শর্ত কাঠামো তৈরি হচ্ছে- তা স্বচ্ছতার পথে নয়; ভবিষ্যতে এটি হয়ে উঠতে পারে ‘আইনসম্মত লুট কাঠামোর’ নজির।

পার্বত্য সীমান্ত সড়ক প্রকল্প আপাতদৃষ্টিতে একটি উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হলেও, দর পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত গোপনীয়তা, অস্বাভাবিক মূল্যহার এবং নজির নিষেধাজ্ঞা- সব মিলিয়ে এটি এখন আর শুধুই একটি অবকাঠামো প্রকল্প নয়; বরং একটি সম্ভাব্য বড় অর্থনৈতিক ঝুঁকি।

প্রশ্ন এখন একটাই : সরকার কি সত্যিই জনগণের জন্য সড়ক বানাচ্ছে, নাকি কোনো অদৃশ্য সিন্ডিকেটের জন্য একটি নতুন অর্থনৈতিক করিডোর খুলে দিচ্ছে?