মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর জটিলতা এখনো ছাড়াতে পারছে না প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর গ্রিন সিগনাল পাওয়ার পরও ঝুলে আছে দেশটিতে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা সাড়ে সাত হাজারের বেশি কর্মীর যাত্রাও। মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এসব কর্মীর অবশ্যই দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুর পৌঁছাতে হবে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে বিদেশী কর্মী আমদানীর ওপর মালয়েশিয়া সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর থেকে কূটনৈতিকভাবে দফায় দফায় চেষ্টার পরও দেশটিতে বৈধভাবে কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে ভিজিট ভিসার নামে অসংখ্য লোককে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার শিপাং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন থেকেই অনেককে ফিরতি ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তারপরও প্রতিদিন কোনো না কোনো ফ্লাইটে অবৈধভাবে লোক যাচ্ছে।
গতকাল কুয়ালালামপুর থেকে একজন সিনিয়র সাংবাদিক নয়া দিগন্তকে টেলিফোনে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আমাদের লোকজনের কারণেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বায়রার পরিচিত এবং চিহিৃত সদস্যরা বাংলাদেশের শ্রমবাজার যাতে না খুলে তার জন্য এশিয়াবিষয়ক একজন মানবাধিকারকর্মীর কাছে একের পর এক বিতর্কিত ডকুমেন্ট পাঠাচ্ছেন। এতে মালয়েশিয়ার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে এমপি-মন্ত্রীসহ অনেকেই বিব্রত। যার কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা নিয়ে তাদের সরকারের আর কোনো মাথাব্যথা দেখছি না। তা ছাড়া দেশটির সরকারও চাচ্ছে, ২০২৬ সাল থেকে স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেবে বেশি। এ লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যে প্রযুক্তি উদ্ভাবক দক্ষ কর্মী গড়ার কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। কারণ তারা বাংলাদেশ এবং নেপাল থেকে লোক আনার পর তাদের দেশের ওপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাভাবে চাপ বেড়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানবপাচার, মানি লন্ডারিংসহ নানা অভিযোগে তাদের দেশের বিরুদ্ধে প্রচার প্রোপাগান্ডা বেশি হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে দেশটির সরকার সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ওই সাংবাদিক মনে করছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি অবশ্য স্বীকার করে বলেন, বৈধ অভিবাসন বন্ধের সুযোগে আমাদের দেশের জনশক্তি ব্যবসায়ীরা এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট করে কোট টাই পরিয়ে এমন সব লোককে ভিসা দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে যাদের বেশির ভাগ না জানে পড়া লেখা, না জানে দস্তখত দিতে ভিজিট ভিসায় আসতে হলেওতো একটা প্রিপারেশন লাগবে। এসব কারণে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে এখনো।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার দৃষ্টিতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, এর আগে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে একজন দক্ষ কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তার নাম শহীদুল ইসলাম। তিনি যেভাবে পেরেছেন দেশটির সরকারের নানা ব্যক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এরপর যেসব কূটনৈতিক দায়িত্বে এসেছেন তারা মালয়েশীয় সরকারের সাথে ঠিক সেইভাবে মিশতে পারেননি। যার কারণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব থেকে শুরু করে অনেক কর্মকর্তাই মালয়েশিয়ায় এসেছেন, সরকারের সাথে যৌথ মিটিং করেছেন কিন্তু তারা কাজের কাজ কিছুই করতে পারেননি বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এখন ইরান থেকে একজন কূটনৈতিক মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন। এখন দেখি তিনি শ্রমবাজার খোলার ব্যাপারে কতটুকু দক্ষতা দেখাতে পারেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করার কথা রয়েছে।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মালয়েশিয়া সরকার বিদেশী কর্মী আমদানিতে কোটা (সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ নেবে) কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত তারা নতুন করে সোর্সকান্ট্রিভুক্ত কোনো দেশের নামেই নতুন করে এপ্রুভাল দিচ্ছে না। তবে আমাদের দেশের আন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এ নিয়ে বৈঠকের পর ভিসা-টিকিটসহ সবকিছু হওয়ার পরও যে সাড়ে সাত হাজার কর্মী যেতে মালয়েশিয়ায় পারেনি তাদের যাওয়ার বিষয়টি অনেকটাই চূড়ান্ত হয়ে আছে বলে শুনছি। আগামী নভেম্বর মাস থেকে তাদের মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে। এসব কর্মীর প্রসেসিং হচ্ছে বোয়েসেল থেকে। অভিযোগ আছে তারা সরকার নির্ধারিত টাকার অতিরিক্ত টাকা নিয়ে এসব কর্মীদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
গতকাল রোববার রাতে বনানী এলাকার একজন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক নয়া দিগন্তকে নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, আমরা কোনো সিন্ডিকেট বুঝি না। আমরা ব্যবসায়ী, আমরা চাই ব্যবসা করতে। যেভাবেই হউক সরকার যেন দ্রুত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি খোলার ব্যবস্থা করে দেয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধের জন্য ১০১ সিন্ডিকেটকে দায়ি করা হয়েছে। ঠিক আছে। আমার জানা মতে, চিহ্নিহ্নত বেশকিছু রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক আছেন, তারা সিন্ডিকেটে না থেকেও মালয়েশিয়ায় হাজার হাজার কর্মী পাঠিয়েছে, করেছেন হাজার হাজার কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা। তারা কারা সেগুলো এজেন্সির মালিক যেমন জানে, তেমনি সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও জানে। তাদের বিষয়ে তিনি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। তার মতে, এ মুহূর্তে অনেক দেশেই কর্মী যাওয়া বন্ধ আছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যারা এ সেক্টরকে অশান্ত করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। একই সাথে শ্রমবাজারটিও খোলার ব্যবস্থা করুক। আর মালয়েশিয়া সরকার যেভাবে শ্রমবাজার খুলতে চাইছে সেভাবেই শ্রমবাজারটি খোলা যায় কি না সেটি আরেকবার আমাদের সরকার ভেবে দেখতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। কারণ আমাদের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ইতোমধ্যে জাপানে লোক পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করেছেন। একই সাথে তিনি সৌদি আরবে যাতে স্বচ্ছভাবে কর্মী যেতে পারে সেজন্য নতুন করে চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। আমরা আশা করছি তিনি আর একটু চেষ্টা করলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটিও তিনি তার দায়িত্বে পালন করার সময় খুলে যেতে পারবেন।



