বিশ্বব্যাংকের ঋণে কোভিড-১৯ প্রকল্প
- দক্ষ জনবলের অভাবে অকেজো স্থাপিত আইসিইউগুলো
- পাঁচ বছরে ৭ জন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন
- রচ বেড়েছে ৪৬৬.৪৩ শতাংশ বা সোয়া ৫ হাজার কোটি টাকা
- পাঁচ বছরে ৭৪.৬৬ শতাংশ অর্থ ব্যয়ে অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ
কোভিড-১৯ দুর্যোগ মোকাবেলা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও ৮৪ শতাংশ মেডিক্যাল ও হাসপাতালে আজো আইসিইউ স্থাপন করা হয়নি। অথচ বিশ^ব্যাংকের দেয়া ঋণের টাকার সুদ গুনতে হচ্ছে। আর যে কয়টিতে স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো জনবলের অভাব ও ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে আছে। অপচয় হয়েছে রাষ্ট্রের করা ঋণের অর্থ। আবার পাঁচ বছরের প্রকল্পে পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে সাতজন। বাস্তবায়নে ত্রুটি থাকায় লক্ষ্য অর্জন হয়নি। খরচ বেড়েছে ৪৬৬.৪৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ২৫৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। পাঁচ বছরে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৭৪.৬৬ শতাংশ অর্থ। আর বাস্তব অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো না হওয়ায় প্রকল্পের অব্যয়িত ২৫.৩৪ শতাংশ বরাদ্দ বা এক হাজার ৬১৮ কোটি ২৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা রয়েছে। আইএমইডির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পান্না কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড বলছে, প্রকল্পে বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা ছিল। তিন মাসের মধ্যে বাকি কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। তাই মেয়াদ বাড়িয়ে বাকি কাজ শেষ করা প্রয়োজন। প্রকল্পের প্রধান কাজ আইসিইউ স্থাপনের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। গত পাঁচ বছরেও ৮৪ শতাংশ হাসপাতালে তা স্থাপন করা হয়নি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার প্রথম করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। করোনার প্রথম মৃত্যুর কথা জানা যায় ১০ দিনবার ১৮ মার্চ। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (২য় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পটি গৃহীত হয়। মূল প্রকল্প প্রস্তাবনাতে জিওবি খাতে ২৭৭ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার টাকা এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকাসহ সর্বমোট এক হাজার ১২৭ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার টাকা প্রাক্কলিত খরচ ধরা হয়। ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিলে একনেক সভায় প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের মেয়াদ এপ্রিল ২০২০ হতে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত অনুমোদন পায়। বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল সোয়া তিন বছর। পরবর্তীতে দুইবার প্রকল্পটির ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ ২য় সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ছয় হাজার ৩৮৬ কোটি ৬৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ধরা হয়। যেখানে জিওবি বরাদ্দ ৪৭২ কোটি ৫১ লাখ ১২ হাজার টাকা এবং বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবি ঋণ পাঁচ হাজার ৯১৪ কোটি ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। প্রকল্পের সংশোধিত অনুমোদিত মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন। এখন মেয়াদ সোয়া পাঁচ বছরে উন্নীত হলো।
আইসিইউ স্থাপন বাস্তবায়ন পর্যালোচনা : পান্না কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, প্রকল্পের অন্যতম প্রধান কাজ আইসিইউ স্থাপন বা অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অনেকটা হতাশাব্যঞ্জক। ৫০টি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের বিপরীতে মাত্র ১৩টি হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে। আর ১৬টি মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালে পোস্ট আইসিইউ স্থাপনের বিপরীতে একটি হাসপাতালেও তা গত ৫ বছরে স্থাপন করা হয়নি। একইভাবে ১৫টি মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালে অবস-আইসিইউ স্থাপনের অর্জনের হার শূন্য।
যেসব হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে এর মধ্যে অনেক হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। আবার কোথাও প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানের সংখ্যা অপর্যাপ্ত অথবা নেই। অর্থাৎ আইসিইউ স্থাপন করার পরও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে সব আইসিইউ অপারেশনাল বা ফাংশনাল করা যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, আইসিইউগুলো পুরোপুরি ফাংশনাল করার তিনটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো- ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ বা স্ট্রাকচার তৈরি করা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা এবং আইসিইউ পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবলের সংস্থান।
প্রকল্পের মূল কাজগুলো হলো : আইএমইডির তথ্য ও প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের অধীনে কাজগুলো হলো, ৫০টি জেলা সদর হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট (১ হাজার বেড) এবং ১০ বেডের ইনটেনসিভকেয়ার ইউনিট স্থাপন (৫০০ বেড)। ২৯টি মেডিক্যাল কলেজ এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরটি-পিসিআরসহ আধুনিক মাইক্রো-বায়োলজি ল্যাবরেটরি স্থাপন। ১৪টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক কেয়ার ইউনিট স্থাপন এবং বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট এবং শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে, প্রতিটিতে একটি করে পেডিয়াট্রিক আইসিইউ ইউনিট স্থাপন। ১৪টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে অবসটেট্রিক আইসিইউ স্থাপন। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন (৭টি ফিলিং স্টেশনসহ তিনটি গ্যাস প্ল্যান্ট)। তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতালে (নিটোর, নিঙ্কডু ও নিন্স) ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট স্থাপন। ২১টি সরকারি হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার ইউনিট স্থাপন। আইইডিসিআর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকস্যাস ডিজিজেস এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে বিএসএল-৩ স্থাপন করা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে অটোমেশনসহ ল্যাব টেস্টিং ফ্যাসিলিটি জোরদারকরণ। লিকুইড মেডিক্যাল অক্সিজেন (এলএমও) রক্ষণাবেক্ষণ এবং রিফিলিংয়ের জন্য ৩০টি সরকারি হাসপাতালে লিকুইড মেডিক্যাল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন। কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন ক্রয় ও সরবরাহ এবং কোল্ড চেইন সিস্টেম শক্তিশালীকরণ। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর (উএউঅ)-এর ভ্যাক্সিন টেস্টিং ল্যাবরেটরি শক্তিশালীকরণ। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় জরুরি সুরক্ষা সামগ্রী ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরববাহ করা। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় জরুরি জনবল সরবরাহ এবং ৬৪টি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে এপিডেমিওলজিক্যাল ইউনিট স্থাপন।
৫ বছরে অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ : আরডিপিপি অনুযায়ী ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (২য় সংশোধিত) ‘শীর্ষক প্রকল্পে আরডিপিপি’র মোট সংস্থান ৬ হাজার ৩৮৬ কোটি ৬৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকার বিপরীতে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত পাঁচ বছরে খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি ৩৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা, যা মোট আরডিপিপি প্রাক্কলনের ৭৪.৬৬ শতাংশ। অবশিষ্ট সময়ে অর্থাৎ জুন ২০২৫-এর মধ্যে তিন মাসে প্রকল্পের অব্যয়িত ২৫.৩৪ শতাংশ বরাদ্দ বা ১ হাজার ৬১৮ কোটি ২৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা ব্যয় করা প্রায় অসম্ভব। প্রকল্প অফিস থেকে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ (যদিও ভৌত অগ্রগতি পরিমাণগত কোনো নির্দিষ্ট সূচক নেই)।