বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী খাত হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে। তবে সাম্প্রতিক ভারতের নেয়া এক সিদ্ধান্ত এ শিল্পের জন্য নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। চলতি বছরের মে মাসে ভারত বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করে, এমন পরিস্থিতিতে রফতানি এখন কেবল সমুদ্রবন্দরনির্ভর হয়ে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সরবরাহ ব্যবস্থায়। এমন পরিস্থিেিত বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য পেতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত দেরিতে পণ্য হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের প্রায় ৪০টি শীর্ষ ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাথে বৈঠক করেছেন। রাজধানীর উত্তরায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এইচঅ্যান্ডএম, পুমা, পিভিএইচ, গ্যাপ, লিডল, আলডি, টচিবো, বেস্টসেলার, টার্গেট ইউএসএসহ নামিদামি ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিরা। বৈঠকে তারা স্পষ্টভাবে জানান, স্থলবন্দর দিয়ে পোশাক আমদানির সুযোগ দ্রুত পুনরায় চালু না হলে ভারতের বাজারে তাদের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ভারতের পোশাক বাজার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল খাত। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এ বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে মানসম্মত পোশাক সরবরাহ করছে। কিন্তু স্থলবন্দর নিষিদ্ধ হওয়ায় এখন সব চালান সমুদ্রবন্দর হয়ে ঢুকছে, যা সময়সাপেক্ষ। সমুদ্রপথে পাঠানো পণ্যের ক্ষেত্রে গর্ভে দুই থেকে তিন সপ্তাহ দেরি হচ্ছে, বিশেষ করে স্বল্পমূল্যের পণ্য খাতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে বলে তারা জানিয়েছেন।
প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় স্থলপথে পণ্য পরিবহন উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য সময় ও খরচ সাশ্রয়ী ছিল। কিন্তু ভারতের এ আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা ক্রেতা ও সরবরাহকারীদের জন্য এক ধরনের ‘সাপ্লাই চেইন শক’ তৈরি করেছে।
বৈঠকে উপস্থিত বৈশ্বিক ব্র্যান্ড প্রতিনিধিরা বিজিএমইএ নেতাদের জানান, ভারতের বাজারে তাদের স্টোরগুলোতে পণ্য ঘাটতি তীব্র হচ্ছে। বিশেষত উৎসব মৌসুমকে সামনে রেখে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিক্রয় চাপে পড়ছে। তারা বিজিএমইএকে অনুরোধ করেছেন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে দ্রুত আলোচনায় বসে সমাধান বের করার জন্য। ক্রেতারা উল্লেখ করেন, ব্যবসার দিক থেকে এ সিদ্ধান্ত মোটেও সহায়ক নয়; বরং রাজনৈতিক কারণে নেয়া হয়েছে। তারা স্পষ্টভাবে জানান, আমরা চাই বাংলাদেশী পণ্য স্থলবন্দর দিয়েই প্রবেশ করুক।
এ সময় বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ক্রেতারা তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন এবং সংগঠনও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তিনি জানান, বিজিএমইএ ইতোমধ্যে ট্যারিফ কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে। দ্রুত সমাধান আনতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনকেও (বিটিএমএ) আলোচনায় যুক্ত করা হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু রফতান প্রবৃদ্ধির দিক থেকেই নয়; বরং টেকসই ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার দিক থেকেও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আমরা শ্রম সংস্কারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি, যা শুধু আন্তর্জাতিক মান পূরণের জন্য নয়; বরং দেশের শিল্পখাতকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করতে।
এ সময় বিজিএমইএ পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল টেকসই উন্নয়নকে সামনে রেখে শিল্পের ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্ব কৌশল তৈরি করা। পোশাক ব্র্যান্ড ও প্রস্তুতকারকদের মধ্যে যৌথ উদ্যোগে একটি কার্যকরী দল গঠন করা হবে যাতে অডিট প্রক্রিয়ার জটিলতা কমিয়ে একটি সহজতর ব্যবস্থা তৈরি করা যায়।
বিজিএমইএ পরিচালক নাফিস-উদ-দৌলা বৈঠকে একীভূত আচরণবিধি নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেন। তিনি বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন ক্রেতা ও সার্টিফিকেশন সংস্থার আলাদা আলাদা অডিট পদ্ধতি কারখানার ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে। যদি একটি একীভূত আচরণবিধি চালু করা যায়, তাহলে শিল্পখাত আরো নৈতিক, টেকসই ও দায়িত্বশীল হবে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে ব্র্যান্ড প্রতিনিধিরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ এখনো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের জন্য জনপ্রিয়। তবে টেকসই উন্নয়ন ও নতুন ডিজাইন যোগ হলে এ শিল্প আরো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে। বিজিএমইএ নেতারা এ সময় ব্র্যান্ডগুলোকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক সংগ্রহ আরো বাড়াতে এবং দেশীয় সরবরাহকারীদের সাথে অংশীদারিত্ব জোরদার করার আহ্বান জানান। এতে কেবল ব্যবসা নয়; বরং শিল্পের গুণগতমান ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাও বাড়বে।
ভারতের নেয়া স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশী পোশাক শিল্পের জন্য তাৎক্ষণিক এক বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বিজিএমইএ ও বৈশ্বিক ক্রেতাদের সম্মিলিত উদ্যোগে সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সাথে শ্রম সংস্কার, পরিবেশবান্ধব নীতি, উদ্ভাবনী পণ্য উন্নয়ন এবং একীভূত আচরণবিধি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশী পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে আরো টেকসই ও শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারবে বলে তারা মনে করেন।