ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের সময় রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় ছয়জন নিরস্ত্র আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ২৯ জুন এ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এটি চলমান গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে প্রথম, যার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানি হতে যাচ্ছে। প্রসিকিউশন বলছে, এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক মামলা হয়ে থাকবে, যা অতীতের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আট আসামির চারজন কারাগারে, চারজন পলাতক : এই মামলায় মোট আটজন আসামি। তাদের মধ্যে চারজন বর্তমানে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তারা হলেন, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো: আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো: সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো: নাসিরুল ইসলাম। রোববার তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং তাদের পক্ষে আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
বাকি চার আসামি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো: আখতারুল ইসলাম এবং সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।
পলাতক এই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তারা এখনো অধরা। ৩ জুন ট্রাইব্যুনাল তাদের হাজির করতে দু’টি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়। পরদিন সে অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। রোববার তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার দিন ধার্য ছিল, তবে তারা কেউই হাজির হননি। ট্রাইব্যুনাল আজ নির্দেশ দেন, পলাতক এই চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হবে।
গুলি করে হত্যা : অভিযোগপত্রের বিবরণ
মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গত ২৫ মে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি ওইদিন অভিযোগটি উপস্থাপন করে তা আমলে নেয়ার আবেদন জানান, যা ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করেন।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন চিফ প্রসিকিউটরের কাছে জমা দেয়। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের সময় রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে ছয়জনকে হত্যা করা হয়।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন- শহীদ শাহরিয়ার খান আনাস, শহীদ শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মো: ইয়াকুব, শহীদ মো: রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো: ইসমামুল হক, শহীদ মানিক মিয়া।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সরকারের উচ্চপর্যায়ের মৌখিক নির্দেশে এসব হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। নিহতরা সবাই ছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্র ও সাধারণ মানুষ।
প্রসিকিউশনের বক্তব্য : চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই মামলার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু একটি বিচারের ঘটনা নয়, বরং এটি নতুন প্রজন্মকে ন্যায়বিচারের বার্তা দেবে। দীর্ঘদিন ধরে যে বিচারহীনতা চলছিল, এই মামলার মাধ্যমে তা ভাঙার পথ তৈরি হলো।’ তিনি আরো জানান, মামলায় বেশকিছু ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ও ফরেনসিক রিপোর্ট সংযুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোর ভিত্তিতে আসামিদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।
পরবর্তী কার্যক্রম : আগামী ২৯ জুন সকাল ১০টায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। গ্রেফতার চার আসামিকে আদালতে হাজির করা হবে। পলাতক চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেবেন।