এটি এমন এক নাটক, যার স্ক্রিপ্ট (চিত্রনাট্য) অভিনেতা মঞ্চে ওঠার আগে পর্যন্ত একবারও পড়ে দেখেন না। চরিত্র সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা থাকে না। এমনকি, কী বলবেন, কোথায় দাঁড়াবেন, কী ঘটবে- তার কিছুই জানা থাকে না। তবুও, বিশ্বের নামী-দামি তারকারা আজ এই নাটকে অংশ নিতে মরিয়া। নাটকের নাম অ্যান ওক ট্রি, আর এটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন খ্যাতনামা ব্রিটিশ থিয়েটার নির্মাতা টিম ক্রাউচ।
এই প্রথাবিরোধী নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২০০৫ সালে। নাটকটি এখন বিশ্ব থিয়েটার জগতে এক বিপ্লবের নাম। ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটি আবারো মঞ্চে আসছে লন্ডনের বিখ্যাত ইয়াং ভিক থিয়েটারে। আর এতে অভিনয়ের জন্য নাম লেখাচ্ছেন ডেভিড টেন্যান্ট, জেসি বাকলি, মীরা সায়াল, মার্ক গ্যাটিস, ইন্দিরা ভার্মা এবং মিশেল টেরি-র মতো তারকারা।
নাটকটির বিশেষত্ব হলো-প্রতিটি শোতে (শো-প্রদর্শনী) একজন নতুন অভিনেতা আসেন, যিনি এর আগে কখনো নাটকটি পড়েননি বা দেখেননি। ওই অভিনেতা কাহিনীর এক প্রধান চরিত্র, একজন বাবা, যার মেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আর অপর চরিত্রটি, যে গাড়ির চালক হিসেবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, সেই ভূমিকায় অভিনয় করেন টিম ক্রাউচ নিজে। নতুন আসা অভিনেতাকে আগে থেকে কিছু জানানো হয় না। মঞ্চে ওঠার মাত্র এক ঘণ্টা আগে তাদের সাথে দেখা করে ক্রাউচ শুধু বলেন, ‘তুমি ভুল করতে পারো না, আবার ঠিক করাও তোমার হাতে নেই।’
এই অনিশ্চিত অভিনয় অভিজ্ঞতা আজ শিল্পের এক নতুন রূপ। এই নাটকে ইতোমধ্যে অভিনয় করেছেন ফ্রান্সেস ম্যাকডোরম্যান্ড, পিটার ডিঙ্কলেজ, মাইক মায়ার্স, ডেভিড হেয়ারউড, টবি জোন্স, সুসান ওকোমা-র মতো হলিউড ও ব্রিটিশ তারকারা।
অভিনেতা টবি জোন্স বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতা ছিল নিজের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে মঞ্চে এক গভীর বিশ্বাসে ডুবে যাওয়ার মতো। প্রথমে একটু ভয় লাগলেও শেষে মনে হয়েছিল, এটা এক অসাধারণ ভাবনা।’
অন্যদিকে, ইন্দিরা ভার্মা জানালেন, তিনি এখন পর্যন্ত নাটকটি করা অন্য কোনো অভিনেতার সাথে কথা বলেননি, কারণ সেটি নিয়মবিরুদ্ধ। ‘কিছু না জেনেই মঞ্চে উঠব। কেবল সময়ের সাথে নিজেকে প্রবাহিত করব,’ বলেন ভার্মা। তার মতে, ‘দর্শকদের জন্যও বিষয়টি দারুণ রোমাঞ্চকর-দেখা যাবে কেউ হয়তো অদ্ভুতভাবে ভুল করছে, আবার কেউ হয়তো এক অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করছে।’
নাটকের কাহিনীর প্রেরণা এসেছিল চিত্রশিল্পী মাইকেল ক্রেইগ মার্টিন-এর এক শিল্পকর্ম থেকে, যেখানে একটি পানির গ্লাসকে বলা হয়েছিল ‘একটি ওক গাছ’। সেখান থেকেই নাটকের ভাবনা, শোকাহত বাবা এক ওক গাছ’কে তার মেয়ে হিসেবে কল্পনা করেন।
নাটকের সহলেখক অ্যান্ডি স্মিথ শুরুতে প্রতিদিন সেই ‘অজানা’ পিতার চরিত্রে অভিনয় করতেন, রিহার্সাল (মহড়া) শেষে নিজের স্মৃতি ‘মুছে’ ফেলতেন যেন আবার নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। পরে বন্ধুদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে, নাটকটির ধাঁচ কেমন অনুভব করছে তারা, কোথায় অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে-তা নিয়ে মতামত নেয়া হতো। টিম ক্রাউচের মতে, ‘এই নাটক একটি ফর্মাল গেম (গঠনমূলক খেলা)। এখানে প্রতিবারই কিছু নতুন ঘটে। এটা আমার মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখে।’
নাটকটি আজ একটি থিয়েটার আন্দোলনের মতো। যেখানে প্রস্তুতি নেই, নির্দিষ্ট ফলাফল নেই, কেবল বিশ্বাস, প্রতিক্রিয়া আর মুহূর্তের ওপর নির্ভরশীল এক নির্মাণপ্রক্রিয়া। ‘এই কাজটি আমি সারাজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটারে করলেও খুশি থাকতাম’, বলেন ক্রাউচ। ‘আজ যখন বড় মঞ্চ ও তারকারা একে আপন করে নিচ্ছেন, তখন মনে হয়, এই কাজটি বৃহত্তর থিয়েটার কাঠামোর প্রতি এক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।’
মিশেল টেরি বলেন, ‘টিম ক্রাউচ হলেন থিয়েটারের সত্যিকারের কারিগর। তার নাটকগুলো, যেমন টিম ক্রাউচের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে ‘ই,মালভোলি’, ‘আই, সিনা-দ্য পোয়েট’, এবং ‘ট্রুথস আ ডগ মাস্ট টু কেনেল’-সবই অভিনব চিন্তাধারায় ভরা।’
অভিনয়শিল্পকে নতুনভাবে দেখানোর এই সাহসী প্রচেষ্টার নাম অ্যান ওক ট্রি, যা ২০ বছরেও ক্লান্ত নয়, বরং দিন দিন আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
-গার্ডিয়ান অবলম্বনে