সাক্ষাৎকারে সারজিস আলম

মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর দায়বোধের বহিঃপ্রকাশ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান

তরুণ এই নেতা বিশ্বাস করেন যে প্রকৃত পরিবর্তন আসে সংগঠিত জনতার ঐক্য থেকে, যেখানে সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করে, তখন ব্যক্তিবাচক ‘নায়ক’ বাদে সমষ্টিগত শক্তি সামনে আসে।

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
সারজিস আলম
সারজিস আলম |ফাইল ফটো

বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়, যা শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনে গড়ায়। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কয়েকজন সাহসী ও দূরদর্শী তরুণ নেতা-তাদেরই একজন সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন ছিল ছাত্রসমাজের অন্তর্গত চেতনার বিস্ফোরণ। কোটা সংস্কার আন্দোলন বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটা ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ আর সমাজের প্রতি দায়বোধের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ। আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে কেবল ছাত্রী-ছাত্ররা নয়, সাধারণ জনগণও নতুন এক চেতনায় জেগে উঠেছিল।’

সারজিস বলেন, তখন মনে হয়েছিল ছাত্ররা যদি নেতৃত্ব না নেয়, তাহলে জাতি আরো পিছিয়ে পড়বে। কোটা আন্দোলনের সময় আমরা যেমন রাজপথে ছিলাম, তেমনই বিশ্লেষণেও ছিলাম। প্রতিটি দিন, প্রতিটি সরকারি পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে বুঝে নিয়েছিলাম যে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো কেমন করে বৈষম্যমূলক হতে পারে। তখন ভাবলাম যদি আমরা চুপ থাকি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও আমাদের কোনো জবাব থাকবে না।

এই দায়বোধ থেকেই আমরা নামি। কারণ, আমাদের কারো তো কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। আমরা তো ক্যারিয়ার কিংবা সুবিধা পাওয়ার জন্য নামিনি। বরং আমরা জানতাম, নামলে হয়তো গ্রেফতার হবো, হয়তো নিখোঁজ হবো, হয়তো পরিবার ভেঙে যাবে। তবু মনে হয়েছিল এই দেশটা তো আমাদেরও, এ দেশের ন্যায্যতার প্রশ্নে যদি ছাত্রসমাজ না দাঁড়ায়, তাহলে আর কে দাঁড়াবে?”

সারজিস আরো বলেন, ‘আমরা নেতৃত্ব নয়, আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছি। এই আন্দোলনের মূল ভাবনা ছিল একক কোনো নেতা বা ব্যক্তির ওপর নির্ভর না করে সমন্বিত ও গণতান্ত্রিকভাবে একটি শক্তিশালী ছাত্র আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলা।’

তরুণ এই নেতা বিশ্বাস করেন যে প্রকৃত পরিবর্তন আসে সংগঠিত জনতার ঐক্য থেকে, যেখানে সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করে, তখন ব্যক্তিবাচক ‘নায়ক’ বাদে সমষ্টিগত শক্তি সামনে আসে। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থেকে উঠে আসা এই তরুণ প্রথমে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মাধ্যমে, পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অমর একুশে হল থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির প্রতি হতাশ হয়ে তিনি ২০২২ সালে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

২০২৪ সালে তিনি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সংগঠক হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় হন, যা দ্রুত রূপ নেয় সারা দেশব্যাপী এক গণ-আন্দোলনে। আন্দোলনের মধ্যমুহূর্তে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং রাজপথের সংঘর্ষেও তিনি পিছু হটেননি। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরও সারজিস স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য পূর্ণ হয়নি, আমরা ফ্যাসিবাদের স্থায়ী অবসান চাই।’ এই বক্তব্যেই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও সংগ্রামের গভীরতা স্পষ্ট হয়। আন্দোলনের পর তিনি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র প্রধান সংগঠক হিসেবে যুক্ত হন। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পান তিনি। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের পথে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং মানবিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা নতুন এই ধারার রাজনীতিতে সারজিস আলম আজ এক গুরুত্বপূর্ণ নাম।

এ প্রেক্ষাপটে, এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে সারজিস আলম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মুখোমুখি হন। এতে উঠে এসেছে তার রাজনৈতিক যাত্রা, আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে তার ভাবনা।

প্রশ্ন : আপনি ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কীভাবে যুক্ত হলেন, আর পরে কেন সরে দাঁড়ালেন?

সারজিস আলম : ছাত্ররাজনীতি শুরুতে আমার কাছে একটা রোমাঞ্চকর ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র মনে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেককে দেখতাম ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছে। প্রথমে আমিও তাদের সাথে থাকতে শুরু করি। অতিথি কক্ষে যেতাম, স্লোগান শিখতাম, নেতাদের বক্তৃতা শুনতাম। মনে হতো, ছাত্রদের জন্য কিছু করার এটিই শ্রেষ্ঠ পথ।

কিন্তু ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত বিভ্রান্তি তৈরি হতে থাকে। বুঝতে পারি, এখানে একটা ভয়ের সংস্কৃতি আছে। অতিথি কক্ষে (গেস্টরুমে) না গেলে ‘ভালো ছাত্র’, ‘ভবিষ্যতের নেতা’ হওয়া যায় না। অতিরিক্ত আদব-কায়দা না করলে তিরস্কার করা হয়। স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, বরং একটা অদৃশ্য নিয়ম-কানুনের বাঁধনে সবাই আবদ্ধ। ২০১৮ এর আন্দোলনে আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল থেকে একটা মিছিল আসে। ওই মিছিলটা রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত আসে। ওখানে আমি একদম সামনে ছিলাম এবং স্লোগান দিয়েছিলাম। তখন থেকেই বিবেকের একটা তাড়না অনুভব করি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন আমার চোখ পুরোপুরি খুলে দেয়। আমি ফেসবুকে কিছু পোস্ট করেছিলাম, যেখানে ছাত্রলীগের কিছু নেতার কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলি। এরপর আমাকে অতিথি কক্ষে ডেকে নেয়া হয়, জেরা করা হয়, পোস্ট মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। এক প্রকার হুমকির মুখেই তখন লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হয়। আমাকে বলা হয়, ‘রাজনীতি করতে চাইলে লেখালেখি বন্ধ করতে হবে, আর লেখালেখি চালিয়ে যেতে চাইলে রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে’ তখন আমি দ্বিতীয়টিকে বেছে নিই। এই সিদ্ধান্তে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ ছাত্রলীগ আমাকে হলের সহসভাপতির পদ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি আমার

প্রশ্ন : আপনি ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর কী পরিবর্তন আসে? আপনি কীভাবে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন? এবং আপনার জীবনে এর প্রভাব কেমন ছিল?

সারজিস আলম : ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন ছিল আমার জীবনের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। নির্বাচনে আমি আমার হলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হই। অনেকেই যেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়, সেখানে আমি একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করে এই স্থান অর্জন করি। এতে আমার প্রতি ছাত্রদের আস্থা প্রমাণিত হয়। আমি সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম কিন্তু সদস্যদের মধ্যে সর্বোচ্চ আর পুরো হলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলাম।

যাই হোক ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে মনোনীত হয়েও, আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলিনি। ডিবেট সার্কিট, সংস্কৃতি ক্লাব থেকে শিক্ষার্থীরা মনোনয়ন পেয়েছিল। একুশে হলে ছাত্রলীগ মনোনয়ন দিয়েছিল ১৩ জনকে, কিন্তু নির্বাচিত হয়েছিল সাতজন। অন্যান্য হলে ভোটে বাধা দেয়ার অভিযোগ থাকলেও, আমাদের হলে সেসব ঘটেনি।

আমি সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে। মোটামুটি ৯০০ জন ভোটার, আমার সংগ্রহ ৬২৪ ভোট, এতে ভেবেছি, আমি শুধু একজন ছাত্র না; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিনিধি। এই জয়ের পর নিজের বিশ্বাসে অটল থাকার ক্লান্তিহীন সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখি এবং অনেক বেশি আত্মসমালোচক হয়ে উঠি। কারণ, এখন আর আমি শুধু একজন শিক্ষার্থী নই, আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রতিনিধি। আমি চেষ্টা করতাম নিজের কাজ দিয়ে মানুষের আস্থা বজায় রাখতে। কিন্তু আবারো বাস্তবতা আমাকে হতাশ করে। নতুন হলে সভাপতি আসার পর শুরু হয় অতিথি কক্ষে জোর করে ছাত্রদের তোলা, অকারণে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা, রাজনৈতিক চাটুকারিতা ইত্যাদি। আমি এসবের বিরোধিতা করি, আবার অনেক সময় চুপ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিই। কারণ আমি বুঝতে পারি আমার অবস্থান আর তাদের আদর্শ এক নয়। একসময় আমি আর কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতাম না, অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতাম। আমি যে রাজনীতির স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম, সেটা তো এখনকার দলীয় চর্চার মধ্যে নেই। নেতৃত্বে গিয়ে যদি নিজের আত্মমর্যাদাই হারাতে হয়, তবে সে নেতৃত্ব আমার দরকার নেই।

প্রশ্ন : ২০২৪ এর কোটা আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হলেন? কিভাবে সবাইকে সংগঠিত করলেন? প্রথম দিকের গল্পগুলো শুনতে চাই।

সারজিস আলম : ৫ জুন বিকেলে খবর এলো সরকার ১৮ নম্বর পরিপত্র বাতিল করেছে। আমি তখন সায়েন্স লাইব্রেরিতে পড়ছিলাম। মাথায় যেন বাজ পড়ল। সেদিন বিকেলেই আমার ভেতরে একটা ঝাঁকুনি কাজ করল, বুঝতে পারলাম, এটা আর শুধু একটা পরিপত্র নয়, এটা সরকারের পক্ষ থেকে একটা ঘোষণা। সরকার চাইল বলেই এটা বাতিল হলো। এই আন্দোলনটা হবে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আর সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়ালে আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। বিসিএস পরীক্ষা ভালো দিয়েও চাকরি না পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ভেরিফিকেশনে বাদ পড়ে যেতে পারি।

তবু সেদিন রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিই যা হয় হোক, আমি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হবো। আমার বিসিএস না হলে না হবে। অন্তত আমি প্রিলি-রিটেন-ভাইভা পর্যন্ত দিয়ে দেখিয়ে দেবো আমাকে বাদ দিলে সেটা হবে অন্যায়। আমার তখনকার মানসিকতা ছিল যদি কিছু না হয়, তাহলে দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করব, চাকরি করব, কিন্তু এই অনৈতিকতার একটা বিহিত আমি দেখে ছাড়ব।

সেদিন রাতেই, ৫ জুন রাত ১১টার দিকে বাকেরের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। সে জানতো যে আমি সায়েন্স লাইব্রেরির অ্যাডমিন প্যানেলের একজন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রেখে কাজ করি। এর আগে আমরা মোকাররম ভবনের পাশে ক্যাফেটেরিয়ার দাবিতে একটা ছোট আন্দোলন করছিলাম। সেখানে খাবারের দোকানগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই। শিক্ষকদের জন্য তো ক্যাফেটেরিয়া আছে, কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ ছাত্ররা সেখানে ২০০ টাকা দিয়ে খেতে পারি না। এই সূত্র ধরেই বাকের আমার সাথে যোগাযোগ করেন। বাকের আমাকে বলেন, ৬ জুন সকালে আমরা সোশ্যাল সায়েন্সের সামনে বসব। আমি শোয়েব ভাইসহ আরো দুজন বন্ধুকে নিয়ে যাই সেখানে। বাইক থেকে নেমে হেঁটে যেতে যেতে মনে পড়ে, আমার বন্ধু হাসনাতকে ডাকি সে ভালো অ্যাকটিভিস্ট, ফেসবুকে ভালো রিচ আছে। ভাবলাম, তাকে যুক্ত করতে পারলে আন্দোলনের প্রভাব বাড়বে। আমি তখনো জানতাম না, বাকের-নাহিদরা আগেই ওর সাথে যোগাযোগ করেছে।

সেখানে দেখি নাহিদ, আসিফ, কাদের, মাহিন, রিফাত, হান্নান, আবু সাঈদ ভাইসহ অনেকেই ছিলেন। তবে বাকের ছাড়া কাউকে আমি চিনতাম না। পরে ভিডিওতে দেখি তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল। আমি চিনতাম সংস্কার আন্দোলনের নূর ভাই, রাশেদ ভাই, ফারুক ভাই, আখতার ভাই, হাসান আল মামুন ভাই এসব মানুষকে।

৬ জুন শহীদ মিনারে আমরা প্রথম মিছিল করি। সায়েন্স লাইব্রেরি ও সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে আলাদা আলাদা মিছিল গিয়ে শহীদ মিনারে একত্র হই। সেখানে নাহিদ উপস্থাপনা করে, আমিও বক্তৃতা দিই। তারপর রাতে বটতলায় আলোচনা হয়। শুক্র ও শনিবার তো ক্যাম্পাস ফাঁকা থাকবে, তাই কর্মসূচি রোববার (৯ জুন) করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে আন্দোলনটা গুছিয়ে আনা শুরু হয়। আমি নিজেও তখন পঞ্চগড় থেকে একটা ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে দিই। কেন কোটা সংস্কারের এই আন্দোলন যৌক্তিক, কেন এটা প্রয়োজন। এইভাবে ধীরে ধীরে আমরা সবাই আমাদের জায়গা থেকে কথা বলতে থাকি, যোগাযোগ করি, তাদের কেউ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে, কেউ ঢাবি হলে, কেউ বাইরে থেকে। শেষ পর্যন্ত, আমরা ১ জুলাই সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে মিছিল শুরু করি, রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত যাই। সেখান থেকে আন্দোলনের মূল পথচলা শুরু হয়।

প্রশ্ন : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামটি কখন ও কিভাবে আসে? আন্দোলনের একতা গঠনের জন্য এই নামের গুরুত্ব কী ছিল?

সারজিস আলম : আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরকে একক নেতা হিসেবে না দেখা হোক। বরং একটা সমন্বয় কাঠামো থাকুক। একই ব্যানারে, একই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হোক। এটাই ছিল দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি। কারণ আলাদা আলাদা ব্যানারে থাকলে, আলাদা আলাদা নেতাদের প্রভাবিত বা দমন করা সহজ। একক প্ল্যাটফর্ম হলে সেটা কঠিন। সেই জায়গা থেকে আমরা নাম দিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে বিভিন্ন ভার্সিটির নামসহ ব্যানার আসছিল, যেমন ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। পরে একরকমভাবে শুধুই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে সবাই আসতে শুরু করল। এতে আন্দোলনের একতা তৈরি হলো, বিভাজন কমে গেল। আমার মনে আছে, আমরা অন্তত ২০টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম পাবলিক, প্রাইভেট মিলিয়ে। এগুলো করতাম আমরা নিজেরা, আমাদের দলের অন্যান্যরা।

প্রশ্ন : আপনাদের আন্দোলনের কৌশল কী ছিল? কীভাবে নেতৃত্বের সমন্বয় ও সংগঠন চালানো হয়েছিল?

সারজিস আলম : আমাদের স্ট্র্যাটেজি ছিল মূলত আমরা তিনজন নাহিদ, আমি আর হাসনাত, সিনিয়র সমন্বয়কের যে প্রথম তালিকাটা বের হয়েছিল, সেখানে নাহিদ ছিল এক নম্বরে, তারপর আমি, তারপর হাসনাত। আমরা তিনজন মিলে একটা কোর টিম তৈরি করেছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, যে কোনো ঘোষণা বা প্রেস ব্রিফিংয়ে আমরা তিনজন একসাথে উপস্থিত থাকব। এ ছাড়াও, বাকের, রিফাত রশিদ, হান্নান, মাসুদ, মাহিন, কাদের এরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল।

শাহবাগ মঞ্চে তিনজনই একসাথে কথা বলতাম। একটা সময় আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মঞ্চে যেতে চাইছিলাম না। তখন পিজি হাসপাতালের পাশের বটগাছটার নিচে বসেছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নাহিদ আমাকে ওখান থেকে ডেকে নিয়ে আসে। বলল, ‘মঞ্চে না থাকলে অনেকে ধরে নেবে তুমি সরে গেছো’। কারণ আমি তো ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা, এটার কারণে যদি মঞ্চে আমি না থাকি, সেটাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হতে পারে। কিন্তু আমি থাকা মানেই একটা ম্যাসেজ এই, আন্দোলনের ভেতরে ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেও কেউ আছে এবং এটা একটা শক্তি। এই মঞ্চটা সরকারবিরোধী ট্যাগ পায়নি, তার একটা কারণ আমি ছিলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই আন্দোলনটা সাহস পেয়েছিল কারণ হলো ছাত্রলীগ করে আসা একটা পরিচিত মুখ মঞ্চে ছিল, যার মাধ্যমে অন্য ছাত্ররাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। একধরনের সুরক্ষা বা প্রোটেকশনের অনুভূতিও কাজ করেছিল যদি কিছু হয়, আমাদের মতো কেউ পাশে থাকবে। আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরকে একক নেতা হিসেবে না দেখা হোক। বরং একটা সমন্বয় কাঠামো থাকুক। একই ব্যানারে, একই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হোক, এটাই ছিল দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি। কারণ আলাদা আলাদা ব্যানারে থাকলে, আলাদা আলাদা নেতাদের প্রভাবিত করে বা দমন করা সহজ। একক প্ল্যাটফর্ম হলে সেটা কঠিন।

আমরা এই কাঠামোয় সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক নামে দুই লেয়ারের নেতৃত্ব তৈরি করি। একজনকে যদি গুম, গ্রেফতার বা টার্গেট করা হয়, অন্য লেয়ার দায়িত্ব নিতে পারবে। এটাই ঘটেছিল যখন আমরা ডিবি অফিসে ছিলাম, এক লেয়ার চলে গেল, আরেকটা দাঁড়িয়ে গেল।

প্রশ্ন : ১৫ জুলাই বিকেলে একাত্তর হলে ছাত্রলীগের হামলা এবং ১৬ তারিখের সংঘর্ষ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

সারজিস আলম : ১৫ তারিখ দুপুরে আমাদের ঘোষণা ছিল ভিসি চত্বর হয়ে শহীদ মিনারে বিক্ষোভ মিছিল করব। কিন্তু খবর আসে একাত্তর হল ও সূর্য সেন হল থেকে ছাত্রদের বের হতে দিচ্ছে না। বাকের মাইক থেকে ঘোষণা দেয়, কয়েকশ জনের মিছিল একাত্তর হলে যায়, সেখানে হামলা হয়, রক্তাক্ত হয় অনেকে।

আমরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম মেয়েদের নিয়ে, উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের নিরাপদ রাখা। ছেলেরা গিয়েছিল পাল্টা ধাওয়া দিতে। পরে, এফবিএসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগ আমাদের ওপর ইট ছোড়ে, মেয়েরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অনেকেই আহত হয়। আমি মেয়েদের নিয়ে ভিসি চত্বর হয়ে এসএম হল পর্যন্ত যাই। কেউ ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হয়নি, কারণ আহতরা সেখানে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ সেখানেও হামলা করে, গুলি, ককটেল ছোড়ে। ঐদিন হাসনাত ছিল টার্গেট ও ভিসির অফিস সংলগ্ন জায়গা থেকে বের হতেই ছাত্রলীগের লোকজন ওর পায়ের ওপর পিটায়, পা একেবারে কালো হয়ে যায়। আমি গাড়ি নিয়ে ওকে ইবনে সিনায় নিই, ওখানে চিকিৎসা হয়। তারা একুশে হলে আমার রুমেও আসে। আমাদের রুমের সামনে ছাত্ররা পাহারা দেয়। কারণ আমরা তখন মূল নেতৃত্বে ছিলাম। পরে একুশে হল থেকেও অনেকে শহীদুল্লাহ হলে যায়। কার্জন এলাকার তিনটি হল তখন চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্রলীগ পুরো ব্যাকফুটে চলে যায়।

১৬ তারিখ শহীদ মিনারে গিয়ে বোঝা যায়- অনেকে সেফ জোনে চলে গেছে, হল ছেড়ে চলে গেছে, মেয়েদের উপস্থিতিও অনেক কমে যায়। তবু ওই দিন শহীদ মিনারের অবস্থান কর্মসূচিতে দুই-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণ ছিল অন্য পাশের তিন হলের ছাত্রদের-ওরাই তখন আন্দোলনের ধারক।

প্রশ্ন : ডিবি থেকে ছাড় পাওয়ার পর ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহীদ মিনারের এক দফা থেকে শুরু করে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং ওই সময়ে সরকারের সাথে যোগাযোগ, কর্মসূচির পরিকল্পনা, নিরাপত্তা ও পরিস্থিতির পরিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত বলুন।

সারজিস আলম : তিন তারিখ সকালে আমরা শহীদ মিনারে বিশাল গণজমায়েতে একত্রিত হয়েছিলাম। আমি আগে এসে সেখানে অবস্থান করছিলাম, পরে হাসনাত, নাহিদ, বাকের, আসিফসহ অন্যরা যোগ দিল। তখনই এক দফার ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর থেকে সরকারের কেউ আর যোগাযোগ করেনি। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ওপর শুটআউট চালানো। পুলিশের ভেতরে এমন কয়েকজন ছিল যারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করত, কিন্তু তাদের ওপরও চাপ ছিল। তারা আমাদের বলত, মিছিলে ঢোকার সময় এমন পোশাক পরে আসতে যাতে ইন্টেলিজেন্স আমাদের চিহ্নিত করতে না পারে। সামনের লাইনে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকতে বলত, কারণ সামনের লাইনে গুলি চালানোর নির্দেশ ছিল। তারা কান্নাকাটি করত নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য, কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, সামনের লাইনে না দাঁড়ালে আন্দোলনের কোনো মানেই থাকবে না, কারণ হাজারের বেশি মানুষ জীবন দিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে, আমরা পিছিয়ে যাব না।

শহীদ মিনার থেকে আমরা সিএনজি করে তেজকুনি পাড়া, মহাখালী, নাখালপাড়া এলাকা দিয়ে আত্মগোপনে ছিলাম। ওই জায়গাগুলো আমাদের পরিচিত ছিল, আমাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় ছিল। আমাদের টার্গেট ছিল অল্প সময়ের জন্য রাস্তায় আসা, মুখ দেখানো এবং দ্রুত লুকিয়ে যাওয়া। কারণ তখন পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর ছিল। নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছিল। চার থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত আমরা এলাকায় পর্যবেক্ষণ চালিয়েছি, কর্মসূচির পরিকল্পনা করতাম এবং সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে আন্দোলনের গতি ধরে রাখার চেষ্টা করতাম।

চার তারিখে দেশে বড় বড় কর্মসূচি হয়। শিক্ষক ও সুধী সমাজের জন্য পাঁচ তারিখে শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জলন ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আমাদের চিন্তা ছিল, যদি বৃহত্তর জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত না করি, তাহলে আন্দোলনের সংখ্যা ও শক্তি কমে যাবে। চার তারিখ রাতে আমাদের গ্রুপ কলের মাধ্যমে আগামী দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়। তখন জানা যায়, শহরে বিশেষভাবে অস্ত্র ও স্নাইপারসহ ডিপ্লয়মেন্ট হয়েছে, তাই আমরা সতর্ক থাকতে চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল, এবং তারা ধরা পড়লে আন্দোলনের মোমেন্টাম নষ্ট হতে পারে। তাই আমরা নিজেদের নিরাপত্তা ও আন্দোলনের শক্তি দুটোই ধরে রাখতে চাই।

পাঁচ তারিখ সকালে বৃষ্টি শুরু হলে হতাশা সৃষ্টি হয়। মনে হচ্ছিল, আওয়ামী লীগ ন্যাচারাল সুবিধা পাচ্ছে কারণ বৃষ্টিতে মানুষ রাস্তায় নামতে পারবে না। ইন্টারনেট শাটডাউন দেয়া হয়, যদিও পরে তা তুলে নেয়া হয়। উত্তরা থেকে খবর আসছিল হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে, আর্মি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনা বেড়েই চলছিল। উত্তরা বিএনএস সেন্টার থেকে ফ্লাইওভার পর্যন্ত মানুষ মিছিল করছে। যাত্রাবাড়ীর গলিতেও জনসমাগম ছিল। সেখানে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হচ্ছিল। আমি বিভিন্ন গলি পর্যবেক্ষণ করছিলাম, মিডিয়া ফলো করছিলাম, আমাদের যোগাযোগ ছিল। যখন সেনাপ্রধানের ভাষণ আসার খবর পাই, বুঝতে পারি বড় কিছু হতে যাচ্ছে। তখনই রাস্তায় নামি। হাজার হাজার মানুষ শাহবাগ থেকে গণভবনের দিকে মিছিল শুরু করে। উত্তরা থেকে মিছিল মেইন রোডে গিয়ে একটি ব্যারিয়ার ভেঙে দেয়। যাত্রাবাড়ীর গলিতে আরো মানুষ যোগ হয়। মিরপুর ডিএইচএস এলাকায় বাচ্চারা সামনের সারিতে ছিল, তাদের পেছনে বাবা-মা। সৈনিকরা তাদের ঠেলতে পারছিল না, পড়ে যায় তারা। বাচ্চারা তাদের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে, অফিসাররা সাইডে সরে যায়। এই দৃশ্য সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব ফেলে। ওই এলাকার অনেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা নিজে রাস্তায় নেমে আসেন।

এইসব পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও গতি ধরে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমরা পিছিয়ে যাইনি, কারণ জানতাম হাজারেরও বেশি মানুষ জীবন দিয়ে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের চাপ, শুটআউটের হুমকি, সামাজিক মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা, সব কিছু মোকাবেলা করেও আমরা সাহস হারাইনি।

প্রশ্ন : কীভাবে জানলেন আন্দোলনের ফলাফল, বিশেষ করে কখন শুনলেন শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেছেন? সেই মুহূর্তে আপনার অনুভূতি এবং আন্দোলনের শেষ পর্যায়ের স্মৃতি নিয়ে কিছু বলবেন?

সারজিস আলম : আমার মনে আছে, তখন আমি তেজকুনি পাড়া থেকে বিজয়সরণীর একটু সামনে একটি গলি দিয়ে বের হচ্ছিলাম। তখন চার দিকে এমন একটা শব্দ আসছিল যে সেনাপ্রধান কিছু বলছেন, পরে মনে হলো দুইবার বলছেন, আর একটা খবর আসছিল যে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। হঠাৎ হেলিকপ্টারে পালানোর ছবি মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। আমরা তখন বাইরে, যোগাযোগ খুবই সীমিত, সোশ্যাল মিডিয়া একটু স্ক্রল করছিলাম, দেখতে পেলাম শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করছেন। ওই মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তখন আমাদের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। মাস্ক পরা ছিল, মাথায় পতাকা বেঁধে ছিলাম, আশপাশের মানুষ বুঝতে পারেনি। যখন মাস্ক খুললাম, তখন দেখি মানুষ আনন্দে হাত-পা ছুড়ে আনন্দ মিছিল করছে।

প্রশ্ন : ৫ আগস্ট যদি অভ্যুত্থান না হতো কিংবা শেখ হাসিনা পালিয়ে না যেত, তখন সশস্ত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা কেমন ছিল? সেই সময় আপনার প্রত্যাশা কী ছিল, আর পরিস্থিতি কেমন ছিল?

সারজিস : হাসিনা ৫ তারিখেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন আমরা এমনটা ভাবিনি। আমরা মনে করতাম, হয়তো আরো কিছুদিন সময় লাগবে, পাঁচ থেকে ১৫ দিন বা তারও বেশি। আমরা ভাবতাম, যখন রাজপথে ডাক দেয়া হবে, তখন সাধারণ মানুষ, প্রশাসনের একাংশ, সিভিল সার্ভিস এবং রাজনৈতিক নেতারা সবাই ধীরে ধীরে রাস্তায় নামবেন। তখন রাজপথে দুই পক্ষ স্পষ্ট হয়ে যাবে, এক দিকে থাকবে ফ্যাসিস্ট এবং তাদের অনুগতরা, অন্য দিকে থাকবে ফ্যাসিস্ট পতনের পক্ষে থাকা সাধারণ জনগণ ও আন্দোলনকারীরা। আমরা তখন একটা ঘোষণা দিয়েছিলাম, সরকারি অফিস, আদালতসহ সব জায়গায় যারা ফ্যাসিস্টদের সহযোগী, তারা অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে এবং শুধু রাজপথে নামবে যারা পরিবর্তন চায়। এই দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলবে, আর সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই ফ্যাসিস্টবিরোধী পক্ষের বিজয় আসবে। লড়াইটা কেমন হবে, সেটা তখন নির্ভর করত পরিস্থিতির ওপর, সশস্ত্র হবে কি হবে না, সেটা তখন ঠিক ছিল না।

প্রশ্ন : অবশেষে এক দফা দাবি কিভাবে সৃষ্টি হলো? এটি আন্দোলনকারীদের থেকে এসেছে নাকি জনতার চাপ থেকেই এসেছে?

সারজিস আলম : ডিবি থেকে বের হওয়ার পর আমরা বুঝতে পারলাম যে, মানুষ আর অপেক্ষা করতে চায় না। তাদের জীবনে দেয়ালের মতো বাধা এসে ঠেকেছে। তারা এখন শুধু পথ দেখতে চায়। তখন মানুষের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মকে তারা তাদের পছন্দের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরকারি চাকরিজীবীরাও বিকালে অফিস শেষে আন্দোলনে যোগ দিত। এটি ছিল শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের ভুলনীতির ফল এবং মানুষের তীব্র আকাক্সক্ষার প্রকাশ। তিন তারিখে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এক দফা দাবি ঘোষণা করি, কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষার উচ্চারণ। সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘এক-১’ চিহ্ন দিয়ে মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে এক বিপ্লব সূচিত হয়েছিল। আমরা শুধু তাদের আকাক্সক্ষাকে তুলে ধরলাম, আর জনগণ তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করল।

প্রশ্ন : অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। তখন মানুষের যে স্বপ্ন, আশা ও আকাক্সক্ষা ছিল, আজ তা কতটুকু পূরণ হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? আজকের দিনে মানুষ কী ভাবছে, তাদের সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়নে কতটা সফল হওয়া গেছে?

সারজিস আলম : ৫ আগস্ট মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা বিশাল। এটি এক দিনে বা এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমি মনে করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরো সাহসী হওয়া দরকার, বিশেষ করে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। তবে এ জন্যে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও দায়িত্বশীল হতে হবে, অবৈধ উপায়গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে ১০ বছর বা এক যুগে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, কিন্তু সেই লক্ষ্যে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।