ফ্যাসিস্টদের আমলে বস্তায় বস্তায় টাকা লেনদেন হতো

ইরাকগামী কর্মীদের নামে নিয়োগানুমতি দেয়ার হিড়িক

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার পর যাচাই-বাছাই শেষে দেয়া হচ্ছে কর্মী বাছাইয়ের নিয়োগানুমতি। তবে ‘গণহারে’ যেভাবে ইরাকগামী কর্মীদের নামে চাহিদাপত্র অনুমোদন দেয়া হচ্ছে আদৌ এসব কর্মীর নামে ইরাকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে কি না তা নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের শ্রমবাজার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবারো বৈধভাবে দেশটিতে কর্মী যাওয়া শুরু হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সি আল-রোটান প্রা: লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান থেকে ১৮০ জন কর্মী যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ইরাকের নতুন শ্রমবাজারের দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে ইরাক থেকে চাহিদাপত্র নিয়ে আসছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার পর যাচাই-বাছাই শেষে দেয়া হচ্ছে কর্মী বাছাইয়ের নিয়োগানুমতি। তবে ‘গণহারে’ যেভাবে ইরাকগামী কর্মীদের নামে চাহিদাপত্র অনুমোদন দেয়া হচ্ছে আদৌ এসব কর্মীর নামে ইরাকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে কি না তা নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিক্রুটিং এজেন্সি আল রোটান সম্প্রতি ১৮০ জন কর্মী ইরাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। এরমধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৩০ জনকে এবং চট্টগ্রামের শহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১৫০ জন কর্মীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় দেয়া হয়।

ঢাকা থেকে ইরাকের উদ্দেশে পাড়ি জমানো কর্মীদের তখন কেউ কেউ যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে বলে গিয়েছিলেন, তারা আড়াই লাখ টাকা খরচ করে (আল রোটান প্রাইভেট লিমিটেডে) ইরাকে যাচ্ছেন। এর মানে তারা সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়েরও বেশি টাকা দিয়ে এসব কর্মীকে ইরাকে পাঠিয়েছেন বলে কর্মীরা বলে গেছেন।

এ দিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বেশ কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ইরাক থেকে চাহিদাপত্র এনে কর্মী বাছাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগানুমতির আবেদন করে অনুমোদন পেয়েছে। আবার অনেকের চাহিদাপত্র এখনো মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান শাখার সংশ্লিষ্ট ডেস্কে জমা পড়ে আছে।

জানা গেছে, আল রোটান প্রাইভেট লিমিটেড সাড়ে ৩ হাজার কর্মীর নামে চাহিদাপত্র ইরাকের বিভিন্ন কোম্পানি থেকে নিয়ে এসেছে। এসব কর্মীর ইরাক যেতে মন্ত্রণালয়ের নিয়োগানুমতি তাদেরকে ধাপে ধাপে নেয়া হচ্ছে। শুধু আল রোটান নয়, ইতোমধ্যে টি এম ওভারসিজ নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এক হাজারেরও বেশি কর্মীর নামে মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগানুমতি প্রদান করা হয়েছে। আরো একাধিক প্রতিষ্ঠানও নিয়োগানুমতি পেতে দৌড়ঝাঁপ করছে।

এ প্রসঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে নয়া দিগন্তকে বলেন, ইরাকগামী কর্মীদের যাওয়ার পর পরিস্থিতি কেমন হবে সেটি দেখার পর তারা এই সেক্টরে ব্যবসা করার চিন্তা করবেন। কারণ ইরাক থেকে যেসব ভিসা এনে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে ইরাকের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ক্লিয়ারেন্স বা সত্যায়ন সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে কি না তাও তারা জানার চেষ্টা করছেন। তাদের মতে, এসব শ্রমিক ইরাকে যাওয়ার পর ভবিষ্যতে চাকরি, বেতনভাতার ঝামেলায় পড়বেন কি না সেটি হচ্ছে বড় কথা। ভবিষ্যতে এসব কর্মী যদি বেকার হয় তখন কিন্তু এর দায় কোনোভাবে মন্ত্রণালয় অথবা বিএমইটি এড়াতে পারবে না। আবার কোনো কোনো এজেন্সির মালিক নয়া দিগন্তকে বলছেন, ইরাকের মার্কেট যেকোনো সময় অশান্ত হয়ে উঠতে পারে, তাই তারা নভেম্বর মাসের পর ইরাকে আর ব্যবসা করতে রাজি নন বলেও কেউ কেউ অকপটে বলছেন।

গতকাল পুরানা পল্টনের একজন এজেন্সির মালিক নয়া দিগন্তকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান শাখা থেকে ইরাকগামীদের ক্লিয়ারেন্স দেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ফাইল ওপরে উঠানো হচ্ছে। যারা এই দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কর্মকাণ্ড ও সার্বিক বিষয়ে গতিবিধি কঠোর নজরদারির মধ্যে আনা দরকার বলেও মন্ত্রণালয় ও এজেন্সি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কারণ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সময়ে সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজার হাজার কর্মীর নামে চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা হতো। এরপর যাদের গ্রিন সিগনাল থাকত তাদের নিয়োগানুমতি হয়ে যেত। এ নিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হতো অনেকটা প্রকাশ্যেই। বস্তায় বস্তায় টাকা লেনদেন হতো। পরে এসব শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার পর অনেকেই কাজ পায়নি। বেতন পায়নি। একইভাবে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির সময়েও মগবাজারে একটি অফিস থেকে বিদেশগামী কর্মীদের নিয়োগানুমতির বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হতো। তখনো বস্তায় বস্তায় টাকা নিয়ে এজেন্সির মালিকরা মগবাজারের ওই অফিসে ছুটতেন। তখন একটি নিয়োগানুমতি নিতে এজেন্সির মালিকদের ৭-৮ হাজার টাকা খরচ করতে হতো। এই বিষয়গুলো বর্তমানে দায়িত্বশীলদের এখন থেকেই মনিটরিং করা উচিত বলে মনে করছেন অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা।