বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে অর্থ প্রত্যাহার নতুন ঘটনা নয়, তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে এই প্রবণতা বাজারে একধরনের কাঠামোগত চাপ তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আচরণ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক পূর্বানুমেয়তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু গত এক বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিনিময় হার অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং ধীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিদেশীদের কাছে ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ দ্রুত কমে যাচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের এমন ঘোষণায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া অর্থনৈতিক সংস্কার শুরুতে বাজারে আশার সঞ্চার করেছিল। বিশেষত গত বছরের আগস্ট-অক্টোবর সময়টিতে বিদেশীদের অংশগ্রহণ বাড়তে দেখা যায়। এ সময় তারা কয়েকটি শক্তিশালী কোম্পানিতে শেয়ারহোল্ডিং বাড়িয়েছিলেন। এটি বাজারে সম্ভাব্য ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সময়ের সাথে এই আশাবাদ দ্রুত নিভে যায়, কারণ বৃহত্তর অর্থনীতির চাপে কোম্পানিগুলোর আয়ের ধারা দুর্বল হতে থাকে এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্রতর হয়। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেন, কারণ তাদের বিনিয়োগের চক্র দীর্ঘমেয়াদি। সেসব বিবেচনায় দেশে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
ব্র্যাক ইপিএল স্টকব্রোকারেজের গবেষণা প্রধান সলিম আফজাল শাওন বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নীতিগত ধারাবাহিকতা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনার নির্ভরযোগ্যতা চান। তিনি মনে করেন, বছরের শেষে কিছু বিনিয়োগকারী মুনাফা ধরে রাখতে বিক্রি করলেও প্রধান কারণ ছিল নির্বাচনী অনিশ্চয়তা। বিদেশীরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না নতুন সরকার গঠনের পর নীতিমালায় কী ধরনের পরিবর্তন আসবে। আর এই ধরনের অজ্ঞাত ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকে সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
অর্থনীতির সামগ্রিক দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির নেমে আসা। অক্টোবর মাসে এই প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৬.২৩ শতাংশে, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সঙ্কোচন ও বিনিয়োগপ্রবাহে স্থবিরতার প্রতিফলন। রয়্যাল ক্যাপিটালের গবেষণা প্রধান আকরামুল আলম মনে করেন, ব্যাংকিং খাতে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ এবং দুর্বল প্রশাসনিক সক্ষমতা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গাকে আরো সঙ্কুচিত করেছে। ব্যাংকিং খাত যদি স্থিতিশীল না থাকে, তাহলে পুঁজিবাজারে মানসম্মত বিনিয়োগ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায় এটাই বিদেশীদের প্রধান বিবেচনা।
পরিসংখ্যান আরো স্পষ্ট করে এই সঙ্কটের চিত্র। নভেম্বর মাসে বিদেশীদের শেয়ার কেনার পরিমাণ ছিল ১.৯০ বিলিয়ন টাকা, বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৩.৩২ বিলিয়ন টাকার শেয়ার। অর্থাৎ নেট বহির্প্রবাহ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৪২ বিলিয়ন টাকা। একই সময়ে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দু’টি ধারাবাহিক মাস সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর বিশ্বে অন্যতম খারাপ পারফরমার হিসেবে চিহ্নিত হয়। বিনিয়োগযোগ্য সিকিউরিটিজের সংখ্যা কমে যাওয়া, নীতিমালার ঘন ঘন পরিবর্তন, দুই বছর ধরে কোনো নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত না হওয়াও এই প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সাধারণত বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারের ওপরই আস্থা রাখেন; কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে অধিকাংশ বহুজাতিক কোম্পানির আয় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কাঁচামাল ব্যয়ের বৃদ্ধি, লজিস্টিক ব্যয় ও উচ্চ সুদের হার এসব কারণ তাদের মুনাফায় চাপ তৈরি করেছে। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত মুনাফা ২৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫ বিলিয়ন টাকায়, যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আরো বিচলিত করেছে।
এই আয়ের চাপে বাজারে ব্লু-চিপ শেয়ারগুলোও টানা দরপতনের শিকার হয়েছে। বিদেশীদের অংশগ্রহণের বড় পতন দেখা গেছে ডিবিএইচ ফাইন্যান্সে, যেখানে তাদের শেয়ারহোল্ডিং এক বছরে ১৭.৩২ শতাংশ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.২৪ শতাংশে। অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজেও বিদেশী অংশীদারিত্ব কমেছে ৩৪.৩০ শতাংশ থেকে ৩২.৯৩ শতাংশে। গ্রামীণফোনেও বিদেশী মালিকানা কমেছে, যা বড় মূলধনী স্টকগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।
তবে এই পুরো পরিস্থিতির মধ্যে ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। দেশের ব্যাংকিং খাত যখন অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের কারণে সমালোচনার মুখে, তখন প্রতিষ্ঠানটি রেকর্ড মুনাফা করে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে সক্ষম হয়েছে। গত বছরের ৩১.৯২ শতাংশ থেকে এ বছরের নভেম্বর নাগাদ তাদের বিদেশী শেয়ারহোল্ডিং বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬.১১ শতাংশে। জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটি ১৫.৩৬ বিলিয়ন টাকার সম্মিলিত মুনাফা করে, যা আগের যেকোনো বছরের বার্ষিক রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া গত এক বছরে ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় ৩৭ শতাংশ, যা বিদেশীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় ক্যাপিটাল-গেইন সুযোগ তৈরি করে।
বিদেশী বিনিয়োগ কমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মুদ্রাবাজারের চাপ। ডলারের বিপরীতে টাকার মান দীর্ঘ সময় ধরে অবমূল্যায়িত থাকায় বিদেশীরা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ তাদের বিনিয়োগের প্রকৃত মূল্য কমে যায় এবং শেয়ারের দাম অপরিবর্তিত থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ সুদের হার এবং নিরাপদ সম্পদ হিসেবে স্বর্ণের প্রতি তীব্র ঝোঁক বিদেশী তহবিল পরিচালকদের বিকল্প গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে উদীয়মান অর্থনীতির শেয়ারবাজারে।
তবে বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি। বিদেশী ফান্ড ম্যানেজাররা বাংলাদেশ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছেন এবং সম্ভাব্য নীতিস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত পেলে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আবার বাড়তে পারে। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতিমালা স্পষ্ট হলে আবারো পুঁজিবাজারে বিদেশী তহবিলপ্রবাহ ফিরতে পারে বলে বাজারসংক্রান্ত বিশ্লেষকরা উল্লেখ করছেন।



