২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের মধ্যে ১১৪টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়। এক বছর ধরে লাশগুলোর পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় চলতি বছরের ৪ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ১১৪টি লাশের উত্তোলনের নির্দেশ দেন। আদালতের এই নির্দেশের তিন মাসেও লাশগুলো উত্তোলন করা হয়নি। তবে জুলাই ফাউন্ডেশন সূত্র জানিয়েছে, নিখোঁজদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই কার্যক্রম শুরু হবে। ডিএনএ থেকে শুরু করে সার্বিক কার্যক্রম করবে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো: শামীম হুসাইন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সর্বশেষ মিটিংয়ে বেওয়ারিশ লাশগুলো উত্তোলনের কার্যক্রম অনেক অগ্রগতি হয়েছে। পিডব্লিউডির পক্ষ থেকে অস্থায়ীভাবে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও এখানে কত টাকা লাগবে তারও একটা বাজেট করা হয়েছে। লাশ উত্তোলনে ম্যাজিস্ট্রেটও নির্ধারণ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে।
জেলা প্রশাসক সূত্র জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকায় লাশ উত্তোলনের বিষয়টি আইনগতভাবে দেখেন পুলিশ কমিশনার। পুলিশই লাশ উত্তোলন, ময়নাতদন্ত, ডিএনএ প্রোফাইল করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা এবং এ সংক্রান্ত মামলার কার্যক্রম শুরু করার বিষয়গুলো দেখে। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে লাশ উত্তোলনের সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠানোর নির্দেশনা দিয়ে রাখা হয়েছে।
আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিতকরণের পর পরিবারের কাছে শহীদদের লাশ হস্তান্তরের জন্য আদালতে লাশ উত্তোলনের আবেদন করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই মো: মাহিদুল ইসলাম। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের আদালত রায়েরবাজার কবরস্থান থেকে বেওয়ারিশভাবে দাফন করা ১১৪টি লাশ তোলার নির্দেশ দেন।
গতকাল এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিক বলেন, বিষয়টি যিনি আদালতে আবেদন করেছেন, তিনিই দেখভাল করছেন।
এ ব্যাপারে এসআই মাহিদুল ইসলাম গতকাল বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের কোনো নির্দেশনা পুলিশের কাছে আসেনি। নির্দেশনা এলেই আমরা লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত ও সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের মাধ্যমে ডিএনএ প্রোফাইল প্রস্তুত করা হবে।
রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, কবরস্থানের বামপাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে ৪ নম্বর ব্লকের ৩৭ নম্বর লেনে সারিবদ্ধভাবে দাফন করা রয়েছে জুলাই আন্দোলনে নিহত ১১৪ জনের লাশ। দাফন করা এসব কবরের পুরো জায়গা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পাকা দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। দেয়ালের কালো টাইলসের ওপর নামফলকে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এর শহীদদের গণকবর’। এ ছাড়াও পুরো দেয়াল জুড়ে কুরআন মাজিদের বিভিন্ন সূরা লেখা হয়েছে।
কবরগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা গোরখোদকেরা বলেন, বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের এই ৪ নম্বর ব্লকে সাধারণত বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে নাম-পরিচয়হীনভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা লাশগুলো প্রশাসনের মাধ্যমে দাফন করা হতো। গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময়ও যাদের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হয়নি তাদের এখানে দাফন করা হয়। অন্যান্য কবরে যেমন নামফলকে নাম-পরিচয় উল্লেখ থাকে কিন্তু এই কবরগুলোতে তা নেই। আন্দোলনের সময় একের পর এক লাশ এসেছে আর আমরা মাটি দিয়েছি। বছরখানেক তো খালি অবস্থাতেই ছিল এই কবরগুলো। সম্প্রতি উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পুরো জায়গায় পাকা দেয়াল করে দেয়া হয়েছে। তাই ডিএনএ প্রোফাইলের মাধ্যমে কারোর লাশ শনাক্ত করা গেলেও নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় কাকে ঠিক কোন জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, জুলাইয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন মর্গ থেকে নাম-পরিচয়হীন মোট ৮০টি লাশ পুলিশের মাধ্যমে দাফনের জন্য আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর আগস্টে আরো ৩৪টি লাশ হস্তান্তর করা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রায়েরবাজার কবরস্থানে লাশগুলো পর্যায়ক্রমে দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। সবশেষ গত ৭ আগস্ট একজন নারীসহ ৬ জন জুলাইযোদ্ধার লাশ এক বছর ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে রাখার পর হস্তান্তর করা হয় আঞ্জুমানের কাছে। তাদেরকেও বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহত যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী সোহেল রানার মা রাশেদা বেগম বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে নিখোঁজ হন তার ছেলে সোহেল রানা। অনেক খোঁজ করার পরও সোহেলের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি ভিডিও দেখে বুঝতে পারি- ওইটা সোহেলের লাশ। এর ৩৪ দিন পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা লাশের নথির মধ্যে সোহেলের ছবি খুঁজে পাই। সেখান থেকে জানতে পারি রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে আমার সন্তানকে দাফন করা হয়েছে। এরপর থেকে অনেকবার রায়েরবাজার কবরস্থানে এসেছি কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি ঠিক কোনটা আমার ছেলের কবর। আমার ছেলের নাম ঠিকানা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মো: জাহিদ হোসাইন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, লাশ উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে আমাদের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে। ময়নাতদন্ত ও সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের মাধ্যমে ডিএনএ প্রোফাইল প্রস্তুত করা হচ্ছে। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যেই আমরা নিখোঁজদের ডিএনএ সংগ্রহের কাজ শুরু করতে পারব। এরই মধ্যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। নিখোঁদের লাশের সন্ধান শিগগিরই মিলবে ডিএনএর মাধ্যমে।



