শিল্প প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা

পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের সঙ্কোচনে বড় শিল্পের গতি কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে

রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরী পোশাক (আরএমজি) এবং দ্বিতীয় বৃহৎ টেক্সটাইল খাতে উল্লেখযোগ্য সঙ্কোচন দেখা দেয়ায় পুরো শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সাম্প্রতিক শিল্প উৎপাদন সূচকে এই চিত্র ফুটে উঠেছে।

শাহ আলম নুর
Printed Edition

দেশের বড় শিল্প খাত চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে যে পুনরুদ্ধারের ইশারা দিয়েছিল, সেপ্টেম্বর মাসে এসে তার গতি মন্থর হয়েছে। রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরী পোশাক (আরএমজি) এবং দ্বিতীয় বৃহৎ টেক্সটাইল খাতে উল্লেখযোগ্য সঙ্কোচন দেখা দেয়ায় পুরো শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সাম্প্রতিক শিল্প উৎপাদন সূচকে এই চিত্র ফুটে উঠেছে।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ৪৬১ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ১১ শতাংশের বেশি জুড়ে থাকা বৃহৎ শিল্প খাত সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে মাত্র ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৭ শতাংশ এবং আগস্টে তা ছিল ৩ শতাংশের কিছু বেশি। তিন মাসের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় যে মন্থর গতি দেখা গেছে, তা শিল্প পুনরুদ্ধারের গতিকে প্রশ্নে ফেলেছে।

শিল্প উৎপাদন সূচকের সবচেয়ে বড় উপাদান প্রস্তুত তৈরী পোশাক খাত। এ খাতের অবদান মোট সূচকের ৬১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এই খাতে উৎপাদন কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্ববাজারে ক্রেতাদের অর্ডার কমে যাওয়া, মুদ্রামানের অস্থিরতা এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব খাতটির উৎপাদনে বড় ধরনের পতন ঘটিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এ দিকে টেক্সটাইল খাত যার অবদান ১১ দশমিক ৬ শতাংশ সেপ্টেম্বরে উৎপাদন কমেছে ৬ শতাংশের বেশি। আরএমজি খাতের ওপর খাতটি সরাসরি নির্ভরশীল হওয়ায় প্রধান রফতানি বাজারের সঙ্কোচন এর উৎপাদনেও বড় প্রভাব ফেলেছে। যদিও বিবিএস-এর বাস্তব উৎপাদনভিত্তিক সূচক মন্থর ছবিই দেখাচ্ছে; কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশের পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ১, যা আগের মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৮ পয়েন্ট বেশি। সাধারণত ৫০-এর উপরে পিএমআই উৎপাদন সম্প্রসারণের ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়।

তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, পিএমআই ভবিষ্যৎ প্রত্যাশাভিত্তিক সূচক, যা মূলত নতুন অর্ডার, পণ্য মজুদ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। অপর দিকে বিবিএসের শিল্প উৎপাদন সূচক তৈরিতে কারখানার বাস্তব উৎপাদনের পরিসংখ্যান বিবেচনা করা হয়। ফলে বাস্তব উৎপাদন কম হলেও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা ইতিবাচক হওয়ায় পিএমআই কিছুটা প্রবৃদ্ধি থাকতে পারে।

বিবিএসের প্রতিবেদনে সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো তামাক খাতে ১০১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি। সাধারণত এই খাতে এত বড় উল্লম্ফন এক মাসে দেখা যায় না। বিশ্লেষকদের মতে, কাঁচা তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের মৌসুমি ধাপ, উৎপাদন সময়সূচির পরিবর্তন এবং বড় কারখানার উৎপাদন চক্রের কারণে এ ধরনের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে। তবে একে স্থায়ী প্রবণতা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধির এই খাতগুলো সাধারণত দেশের অবকাঠামোগত প্রকল্প, যানবাহন বাজারের সম্প্রসারণ এবং অভ্যন্তরীণ ভোক্তাচাহিদার সাথে সম্পর্কিত। ফলে এ খাতগুলোর অবস্থান শিল্প খাতে কিছুটা ইতিবাচকতার বার্তা দেয়।

বিবিএসের ২৩টি বড় উপ খাতের মধ্যে সাতটি খাতে উৎপাদন কমেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফার্নিচার খাত। এ খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মন্দাভাব ও আমদানি ব্যয়ের বৃদ্ধি এই খাতগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে।

গত কয়েক মাস ধরে ‘লেটার অব ক্রেডিট’ (এলসি) খোলার জটিলতা শিল্প খাতের কার্যক্রমে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যায় পড়ে। এর প্রভাব পড়েছে কারখানার উৎপাদন ও সরবরাহ চক্রে। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে কিছু ব্যাংকে এলসি খোলার পরিস্থিতি সহজ হয়েছে। শিল্পমালিকরা আশা করছেন, এর প্রভাব অক্টোবর ও নভেম্বরের উৎপাদনের ওপর ইতিবাচক হবে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মসরুর রিয়াজ বলেন, যখন সূচকের সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা খাতগুলো পড়ে যায়, তখন পুরো শিল্প উৎপাদন সূচককে নিচে নামতে বাধ্য করে। সেপ্টেম্বরে এরই প্রতিফলন দেখা গেছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, এখন প্রকৃত উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, যা অতীতের তুলনায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। আগে যেসব প্রভাবশালী বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিপুল ঋণ নিয়ে অর্থ বিদেশে পাচার করত বা অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করত, তাদের দৌরাত্ম্য কমেছে। এখন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম দেখালেও ঋণের মান অনেক উন্নত হয়েছে। শিল্পের প্রকৃত উদ্যোক্তারা উন্নতি অনুভব করছেন বলে তিনি মনে করেন।

তথ্যে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় বড় ক্রেতা মজুদ কমাতে নতুন অর্ডার দিতে সতর্কতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের কিছু শিল্পে অর্ডার বাড়লেও তা টেকসই প্রবণতা কি না তা নিশ্চিত নয়। শিল্পমালিকদের মতে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রয়াদেশকে আরো সংবেদনশীল করে তুলেছে।

যদিও সেপ্টেম্বরে শিল্পে মন্থরতা স্পষ্ট, তবে আগামী দুই মাসে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সেপ্টেম্বরে শিল্প খাতের যে নিম্ন প্রবণতা দেখা গেছে, তা মূলত রফতানিনির্ভর পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের সঙ্কোচনের সরাসরি প্রভাব। যদিও কিছু উপ খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে; কিন্তু সূচকের বৃহত্তর অংশই দুর্বল থাকায় সামগ্রিক চিত্র নেতিবাচক হয়েছে। এলসি-সঙ্কট কাটতে শুরু করেছে, যা শিল্পের জন্য ইতিবাচক। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের অনিশ্চয়তা না কাটলে রফতানিনির্ভর খাতগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে শিল্প প্রবৃদ্ধির গতি টেকসই করতে এখনই প্রয়োজন স্থিতিশীল মুদ্রানীতি, সহজ এলসি পরিবেশ, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধিমূলক পদক্ষেপ এবং স্থানীয় শিল্পে কর সুবিধাসহ দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা দরকার বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।