বিশিষ্ট আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী বলেছেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে দেয়া আদালতের রায় মানা বা না মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সংসদ যদি এটাকে আমলে না নেয় তাহলে রায় মানলে কী হবে? গণভোট কিন্তু সংবিধানের ঊর্ধ্বে, সেখানেও কথা হচ্ছে সংসদ গণভোটের ফলাফল আসার পর যদি মনে করে তাহলে তারা এটি এক্সসেপ্ট করবেন, তা না হলে করবেন না। তার মানে কী? গণভোট হলো হায়েস্ট ফোরাম। জনদাবি। সেই জনদাবিকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। কোর্টের ভারডিক্ট তো সংসদের জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। এটা হলো আইন সভা। এটা পলিসি মেকিং করে। পলিসি মেকিং তো কোর্ট করে দিতে পারবে না।
তিনি বলেন, তাহলে তো আমার পার্লামেন্ট লাগে না। আপনি গাইড লাইন দিয়ে দেন। দেশ কিভাবে চলবে, মন্ত্রিপরিষদ বানিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেন। সুপ্রিম কোর্টের ভারডিক্ট সংসদের জন্যে ম্যান্ডেটরি নয়। সংসদ যদি এটাকে রিজেক্ট করে দেয় তাহলে করার কিছুই নেই। সংসদ যদি এ রায়কে গ্রহণ করে তাহলে কেউ কিছু বলতে পারবেন না।
নয়া দিগন্ত : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনতে আদালতের রায়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আবু হেনা রাজ্জাকী : জাজমেন্টের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত না এলেও পরবর্তী সংসদ এসে যদি ভাবত যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফেরত যাবে তাতে কোনো বাধা ছিল না। সংসদ যেকোনো সময়েই চিন্তা করতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আনতে পারে। সংসদে বিল উত্থাপনের পর তা ভোটের ভিত্তিতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ হবে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাজমেন্টের মাধ্য ফেরত এলে বা না এলে কিছু আসে যায় না। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত না আসত তাহলে পার্লামেন্ট চাইলে এটি পুনর্বহাল করতে পারে। আর ফেরত আসার পর যদি অগ্রাহ্য করে তাতেও কিছু করার নেই।
যে জাজমেন্ট আসে তা সংশোধন আকারে সংবিধানে ঢোকাতে হবে। আমাদের ১৭তম সংশোধনী পর্যন্ত হয়েছে। ১৮তম সংশোধনী হবে। এটাকে যদি সংবিধানে ইমপোজ করতে বা নিতে হয় তাহলে ১৮তম সংশোধনীর প্রয়োজন হবে। প্রতিটা সংশোধনী এক-একটি সংবিধানের অংশ। এর আগে এ বি এম খায়রুল হক যখন রায় দিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলো তখন বাতিলের ভিত্তিতে কাজ হয়নি, এটার ভিত্তিতে পঞ্চদশ সংশোধনী লেগেছে। জাজমেন্টে কিছু আসে যায় না, সংশোধনী করতেই হবে।
জাজমেন্টে বলা হচ্ছে ১৪তম নির্বাচন থেকে এটি কার্যকর। তাহলে ১৩তম নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে না কেন? এটাই জটিলতা। কারণ ১৩তম নির্বাচনে এ রায় কার্যকর করবে কিভাবে। সংসদতো নেই। জাজমেন্টে কিছু আসে যায় না। সংসদে এটা সংশোধনী আকারে ঢুকতে হবে। সে কারণে বলা হচ্ছে ১৪তম নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে। আবার জাজমেন্ট দিলে সাথে সাথে কার্যকর করতে হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আরো একটা নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে। এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সেটিতো মানলই না। তারপর তিনটি নির্বাচন করে ফেলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া। চতুর্থ নির্বাচনও তাই হচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : বলা হচ্ছে দণ্ডবিধির ২১৯ ধারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে অপরাধ করা হয়েছে, এ অপরাধের বিচার হবে কি?
আবু হেনা রাজ্জাকী : অপরাধ করেছে তা কি আদালত বলেছে? আপনি আমি বললে কাজ হবে না। এই যে জাজমেন্ট দিয়েছে এর ভেতরে ইনক্লুড করে ফাইন্ডিংসে তা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে আদালত কী করল না করল বড় কথা নয়, আদালতের ভুলের জন্যে আপনি কিন্তু আদালতের অ্যাডভান্টেস পেয়েছেন। রিভিউ করে। কথার কথা বলছি ওই কোর্ট ভুল করেছিল, রাজনৈতিকভাবে দেখলেতো মনে করেন শেখ হাসিনা এবং এ বি এম খায়রুল হক দু’জনে প্ল্যান করে এটা করেছেন। সেটিতো আপনি কাগজে কলমে আনতে পারবেন না। কাগজে কলমে আসছে এ বি এম খায়রুল হক রায় দিয়েছেন। তো উনি যে রায় দিয়েছিলেন তাতো রিভিউয়ের মাধ্যমে শুদ্ধ হয়ে গেল।
নয়া দিগন্ত : তাহলে এখন যে রায় দিলো আদালত, ভবিষ্যতে তা রিভিউয়ের মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে?
আবু হেনা রাজ্জাকী : এই রায়ের কোনো ইমপ্যাক্ট নেই।
নয়া দিগন্ত : প্রাপ্তিটা কী?
আবু হেনা রাজ্জাকী : কোনো ইফেক্ট নেই। এ জাজমেন্টে কিছু পাওয়া যায়নি। ধরেন এ জাজমেন্ট হয়নি, অফ রয়েছে। তাহলে নির্বাচনের পর সংসদ পারে কি না তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনতে? কোনো আইন ছাড়া কোনো কিছু ছাড়া? দ্বিতীয়ত কোর্ট অর্ডার দিলো, যদি সংসদ না আনে তাহলে আপনি কী করবেন? তাহলে এই জাজমেন্টের ইমপ্যাক্টটা কী? এই জাজমেন্ট না এলে তারপরও সংসদ যদি মনে করত যে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরত যাবো সেখানে তো কোনো বাধা নেই। যেহেতু এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত না আনলেও সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরত যেতে পারে, আবার রায় আসার পর সংসদ যদি মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরত যাবো না, দুটো অপশনই সংসদের আছে। কোর্ট সংবিধান লিখতে পারে না। কোর্ট আইন বানাতে পারে না। কোর্ট সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন যদি সংসদ বানায় তাহলে ওই আইনের সাংঘর্ষিক অংশটুকু বাতিল করতে পারে। ইভেন পার্লামেন্ট যদি কোনো সিদ্ধান্ত আনল কোনো সংশোধনী এনে যে, এই এই জিনিস বাতিল করব, কথার কথা, কিছু সেকশনে, কিছু অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনল, পরে দেখা গেল কিছু মৌলিক অধিকারের ওপর হ্যাম্পার হয়ে গেল, সংবিধানে যে মৌলিক অধিকার দেয়া আছে, মৌলিক অধিকার খর্ব করে পার্লামেন্ট কোনো সংশোধনী এনে থাকে সংবিধানের মধ্যে, তারপরেও কোর্ট এটা বাতিল করতে পারবে না। কারণ সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন। এটার কেউ ভুল ধরলে আবার একটি বিল আনতে হবে পার্লামেন্টে। বিল আনার পর ব্যাখ্যা হবে, লড়াই হবে, তারপর দরকার হলে আরেকটা সংশোধনী এনে আবার পরিবর্তন করা হবে।
নয়া দিগন্ত : তো কোনো একসময় ভবিষ্যতে বা ধরেন ২০ বছর পর কেউ মনে করল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর প্রয়োজন নেই তাহলে কি এটা বাতিল বা পরিবর্তন করা যাবে?
আবু হেনা রাজ্জাকী : ২০ বছর পরে কেন, যদি তিন মাস পর মনে করে তাতে বাধা কোথায়? ২০ বছর পর পারবেন তো তিন মাস পরে পারব না কেন? কালকে সকালে পারব না কেন? যদি পার্লামেন্ট কার্যকর থাকে।
নয়া দিগন্ত : আদালতের রায় এ ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়?
আবু হেনা রাজ্জাকী : পঞ্চদশ সংশোধনী হলো ২০১১ সালে। খায়রুল হকের জাজমেন্টের ভিত্তিতে। সেটি ২৯১ ভোটে পাস হয়েছিল। ভোট লাগবে কেন? কোর্টে জাজমেন্ট যদি বাধ্যতামূলক হয় তাহলে তো পার্লামেন্টে ভোটের দরকার নেই। ওই যে ভোট লাগে তার মানে রায়ের কোনো ইমপ্যাক্ট নেই। ওইখানে যদি ভোট না লাগত, ২৯১ ভোট যদি ‘হ্যাঁ’ হতো তাহলে হইত? তাই রায়ের কোনো ইমপ্যাক্ট নেই।
নয়া দিগন্ত : তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন পাস হয়েছিল তখন কিভাবে হয়েছিল?
আবু হেনা রাজ্জাকী : ১৯৯৬ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাস হলো সংসদে, তখন এটা ২৬৮ ভোটে পাস হয়েছিল। তার মানে সংসদ সর্বময়। আপনি যে প্রস্তাবই আনেন বিল আকারে আনতে হবে, অ্যান্ড ইফ ইট ইজ অ্যাপরুভ বাই দা পার্লামেন্ট দেন ইট ইজ ফাইনাল। এখন ওই জাজমেন্ট না এলেও পার্লামেন্ট যদি মনে করে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরত যাবো, পার্লামেন্ট হ্যাজ দ্যা রাইট টু ডু ইট এবং ভোটে পাঠাবে।



