লালবাগের আতঙ্ক হাসিবুর রহমান মানিক ও মতিউর রহমান জামাল। তারা এলাকায় ‘গুরু-শিষ্য’ হিসেবে বেশ পরিচিত। শিষ্য মানিক ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আর গুরু জামাল ছিলেন লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাদের নির্যাতনের ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ সবসময় ভয়ে তটস্থ থাকতেন। মানিক সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় বড় হলেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পরই মূলত নতুন করে উত্থান ঘটে তার। এই সুযোগে গুরু জামালেরও ক্ষমতার দাপট বেড়ে যায়। গুরু-শিষ্যের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজির কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা জানান, এতিমখানায় পড়াবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন মানিক। তখন জামালের সাথে সখ্য গড়ে ওঠে। ওই জামালের হাত ধরেই মানিক ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই দু’জনে মিলেমিশে লালবাগে দখলবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম ও ভাগবাটোয়ারা শুরু করেন। এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করতে গড়ে তুলেন নিজস্ব ক্যাডারবাহিনী। এসব অপকর্ম থেকে বাঁচতে কখনো ঢাল হয়েছেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন আবার কখনো তারা হাজী সেলিমের ওপর ভর করে পার পেয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
ঘরবাড়ি দখল
লালবাগ এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, মানিক বর্তমানে যে বাড়িতে থাকেন সেটি সেলিম নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ডেভেলপার হিসেবে নিয়েছেন। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বাড়ির বাসিন্দারা। এ ছাড়া বায়না করে সেলিমের চাচাদের কাছ থেকে নিয়েছেন পাশের বাড়িটিও। টাকার বিনিময়ে ৬/২ শেখশাহ বাজারে মুক্তিযোদ্ধা মিলন মৃধার বাড়িটি দখল করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে মানিকের বিরুদ্ধে। জামালের মধ্যস্থতায় লালবাগের সেই সময়কার উপকমিশনার ইব্রাহিম খান ও ওসি মিলে বাড়িটি দখল করেন। পরে আরেক ঘটনায় ডিসি ইব্রাহিমকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ওসিকে বদলি করা হয়। স্থানীয়দের ভাষ্য, আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারে গণপূর্ত বিভাগের অধীনে ছয়টি ২০ তলা ভবনে ৪৫৬টি ফ্ল্যাট ও প্রায় ৩০টি ২০তলা ভবন নির্মাণসহ এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার কাজ পান তিনি। ভবন নির্মাণে সিমেন্ট ও পাথর সরবরাহ করে জামাল-মানিক সিন্ডিকেট। এ ছাড়া তারা কলোনির বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজের ঠিকাদারিও করেন।
চাঁদাবাজির অভিযোগ
স্থানীয় সূত্র বলছে, আজিমপুর ইডেন কলেজ ও মেটারনিটি এলাকাটি যেন বাসটার্মিনালে পরিণত হয়েছে। দিন-রাত সেখানে রাখা হয় শত শত বাস। বাসের কর্মচারীদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক সেবনের অভিযোগ। এলাকাবাসী জানান, কাউন্সিলর হওয়ার পর এ টার্মিনালে ‘বিকাশ পরিবহনের’ টাকা উঠতো মানিকের নামে। আর অন্যান্য পরিবহনের টাকা উঠতো মানিকের গুরু জামালের নামে। টার্মিনাল সরানো ও চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন দফতরে ‘নাগরিক কমিটির ব্যানারে’ আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু এরপরও কিছু হয়নি।
মানিক-জামালের ক্যাডার বাহিনী
মানিক-জামালের ক্যাডার বাহিনীর কাছে রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের ভাণ্ডার। তারা প্রায়ই এলাকায় মহড়া দেন, চলাফেরা করেন ক্যাডারবেষ্টিত হয়ে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দখল-চাঁদাবাজি-টেন্ডার বাণিজ্যে মানিক-জামালের সহযোগী মাকসুদ ওরফে ইয়াবা মাকসুদ, হাতকাটা মিজান, মহসিন আজাদ, সাব্বির, মালেক, যুবলীগের জাফর আহমেদ রানা, তার ভাই রাশেদ কামাল ও বাদল। রানার বিরুদ্ধে আলীরঘাট এলাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে।
এতিমখানার সম্পত্তিতে নজর
স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় হাসিবুর রহমান মানিক বড় হলেও শেষতক সেই এতিমখানার জমির ওপর নজর পড়ে তার। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সলিমুল্লাহ এতিমখানার ৪০ কাঠারও বেশি জমিতে সম্প্রতি একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ২২ তলা ভবন নির্মাণ শুরু করে। এ নিয়ে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে ভবন নির্মাণ কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই সম্পত্তিতে নজর পড়েছে মানিক ও তার সহযোগীদের। তারা সুযোগ বুঝে এ সম্পত্তি দখলে নিতে চায়। এতিমখানার এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, ২০ বছর আগে এখানে চাকরি নিয়েছেন তিনি। চাকরির প্রথম দিকে মানিক এই এতিমখানার ছাত্র ছিল।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে মার্কেট দখলের চেষ্টা : লালবাগের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে ডিএসসিসির একটি মার্কেট রয়েছে। কাউন্সিলর হওয়ার পরই ফুটপাথে দোকান তৈরির কাজ শুরু করেন মানিক। স্থানীয় লোকজন বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলে। পরে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দোকানগুলো ভেঙে ফেলা হয়। মন্দিরসংলগ্ন মার্কেটের দোকানিরা জানান, মার্কেট দখলের জন্য কাউন্সিলর মানিক দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছেন। তার লোকজন খালি জায়গায় জুয়ার আসর বসিয়েছে। পুনর্বাসন না করেই মার্কেট ভাঙার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দোকানিরা হাইকোর্টে রিট করেন। পরে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় মানিকের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এক ব্যবসায়ী জানান, ১৯৮৫ সালে গণপূর্ত বিভাগ থেকে এসব দোকানের বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে মার্কেটটি সিটি করপোরেশনে ন্যস্ত হয়। মানিক কাউন্সিলর হওয়ার পর সেখানে ১২ তলা ভবন তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজউকের গেজেটে রয়েছে, মন্দিরের ১২০ মিটারের মধ্যে বহুতল ভবন করা যাবে না। এ বিষয়ে দু’টি মামলা রয়েছে। একটি মামলার রায় দোকানিদের পক্ষে।
লেডিস ক্লাবে মাছ ও পাখির চাষ : ১৯৫৬ সালে প্রায় এক একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় আজিমপুর লেডিস ক্লাব। সরকারি কোনো অনুমোদন ছাড়াই এই ক্লাবে মাছ চাষ ও পাখি পালন করেছিলেন মানিক ও জামাল। ক্লাবের পেছনের অংশে বিশাল নেমপ্লেটে ওই খামারের নাম দেয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু মিনি সাফারি পার্ক’। স্থানীয়দের অভিযোগ, জামাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। তিনি ওই ক্লাবে পার্কের আড়ালে ইয়াবা ও ফেনসিডিল লুকিয়ে রাখেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। ক্লাবের এক নারী সদস্য বলেন, সেখানে টার্কি ও দেশী মুরগি, হরিণসহ আরো অনেক পশুপাখি পোষা হতো। সম্প্রতি সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর সেগুলো সরিয়ে নেয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাফারি পার্কের নাম করে কাউন্সিলর মানিক ও আওয়ামী লীগ নেতা জামাল সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে পালন ও চাষ করতেন।
মানববন্ধন করেও লাভ হয়নি
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালেও হাসিবুর রহমান মানিকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও দখলবাজির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠলেও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে পার পেয়ে যেতেন। ২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি মানিকের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ এনে ‘২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বস্তরের জনগণ’ এর ব্যানারে ধানমন্ডি ৩/এ আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ওই মানবন্ধনে জুনায়েদ হোসেন নামে একজন অভিযোগ করেন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বস্তরের জনগণ এই মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেছে। মানিকের গুণ্ডা বাহিনীর বাধার কারণে প্রেস ক্লাবে নির্দিষ্ট সময়ে মানববন্ধন করতে পারিনি। পরে বেলা ২টায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। মানববন্ধন চলার সময় ধারণ করা একটি ভিডিওতে মুখে কালো কাপড় পরা একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘মানিকের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। তার ভয়ে আমরা প্রেস ক্লাবেও উপস্থিত হতে পারিনি। এতিমখানায় তিনি বড় হয়েছেন। সেই এতিমখানার টাকা তিনি মেরে খেয়েছেন। এর থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।’
এদিকে আজিমপুরে কলেজছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহকে হত্যার মামলায় সাবেক কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিককে ২০২৪ সালের ২২ আগস্ট লালবাগ থানার কেল্লার মোড় এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে আব্দুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায়ও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। হাসিবুর রহমান মানিক কারাগারে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।