নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল আগামীদিনের রাজনীতিকে আরো স্পষ্ট করবে এবং আগামী নির্বাচনে তা অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। ডাকসু নির্বাচন আগামী দিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা বাতিঘর হোক, এটা আমার আকাক্সক্ষা। এমন করেই আমাদের ডাকসুকে গ্রহণ করা উচিত।
তবে যেভাবে বলা হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সূতিকাগার ডাকসু তিনি তা মনে করেন না। এ প্রসঙ্গে মান্না বলেন, এ দেশের মুখ্য নেতৃত্বে যারা এসেছেন তারা কেউ ডাকসুতে ছিলেন না। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে সর্বশেষ বেগম খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার কথা যদি বলি তাহলে উনারা কেউ এই জায়গায় ছিলেন না।
আবার রাজনীতিতে যারা মুখ্য ছিলেন, সেই অর্থে মান্না ডাকসুকে সূতিকাগার মনে করে বলেন, এটা একটা ট্রেনিং সেন্টারের মতো তো বটেই, ভোটের প্যাটার্নের সাথে যুক্ত হলো, বিভিন্ন জনের মন বুঝা, চিন্তাভাবনাকে অ্যাকোমোডেশন করাটা শিখল এবং তার মধ্যে একটা সহনশীলতা আসল সেই অর্থে এটা খুব একটা জরুরি জিনিস, এটা নেতৃত্ব তৈরির কারাখানাও বটে সেই অর্থে।
নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদুর রহমান মান্না এসব কথা বলেন।
নয়া দিগন্ত : বলা হয় আজকের ডাকসুর নেতৃত্ব আগামী দিনের রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন?
মান্না : একদম মুখ্য নেতৃত্বে হয়তো সবসময় যাবে না। ডাকসুর যারা ভিপি-জিএস হয়েছেন তারা জাতীয় রাজনীতিতে অনেকেই আছেন চিহ্নিত। একই সাথে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন- আমিতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, তারপর সেন্ট্রাল কমিটিতে ছাত্রলীগের বা বিএনপির ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি যারা ছিল তারা বাইরে ছিল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বা অন্য জায়গাতে ছিল। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই এই ছাত্র সংসদ ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে অসাধারণ ভূমিকা রাখে।
নয়া দিগন্ত : পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব চর্চা ও বিকাশ আরো জরুরি হয়ে পড়েছে?
মান্না : রাজনীতি আগে যেরকম ছিল খালি আবেগের ওপর নির্ভর করে পেশিশক্তি দিয়ে, মানি মাসল দিয়ে কিন্তু এইবার সংস্কার কর্মসূচি আসবার পরে আপনাকে তাত্ত্বিকতার মধ্যে যেতে হচ্ছে, নলেজ বেইজড পলিটিক্সে যেতে হচ্ছে, আপনাকে সংস্কার কর্মসূচি বুঝতে হচ্ছে, এই চর্চাটা রাজনীতির একটা গুণগত দিকনির্দেশনা করে। এইটা সামনে আসবেই।
নয়া দিগন্ত : তাহলে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে চিন্তা ও মেধার চর্চা আসবে এমন ডাকসু নির্বাচন চাচ্ছেন, যা আগামীদিনের রাজনৈতিক সংস্কারের চাহিদা পূরণেও সহায়তা করবে..
মান্না : হ্যাঁ অবশ্যই।
নয়া দিগন্ত : কেউ কেউ বলছেন শিক্ষার্থীরা অনেকটা রাজনীতিবিমুখ তাদেরকে ডাকসুর মাধ্যমে কি রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলা সম্ভব?
মান্না : যেভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন পরিচালনা করার চেষ্টা করুক না কেন শেষ পর্যন্ত ছাত্ররা কেউই সমাজ বহির্ভূত চিন্তা করতে পারবে না। আর সমাজের মধ্যে ক্রিয়া মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে তাতে সে রিয়াক্ট করবেই। তার নিজের জীবনের তাগিদে, তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক সব মিলে যে দায় তার, এমনকি তার শিক্ষাজীবন যাতে ভালো হয়, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার যেন মান বাড়ে, হলের ভেতর গেস্টরুম কালচার যেন না থাকে, বুলিং না হয়, ন্যাচারালি সে চাবে। সবই কিন্তু ডেমোক্র্যাসির সাথে যুক্ত। জাতীয় রাজনীতির পরিশীলনের জন্য দরকার। ডাকুসু তাই হওয়া উচিত। যেটা আলোর বাতির মতো। আগামী দিনের জন্য আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তুলবার জন্য বাতিঘর হিসেবে তাকে কাজ করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : প্রতি বছরেই ডাকসু নির্বাচন করা সম্ভব?
মান্না : ডাকসুকে ট্রেড ইউনিয়ন বডি বানানো যাবে না। ছাত্র রাজনীতি বিবর্জিত যেন না হয় ডাকসু। প্রতি বছরেই ডাকসু নির্বাচন হতে হবে। আমি তো ওটার জন্য ফি দিচ্ছি প্রতি বছর। আজকে যে ছাত্র কালকে সে দেশের নাগরিক। তারপর তার মধ্যে সমাজ চিন্তা কাজ করবে। ছাত্রদেরকে কখনো সমাজ থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না। ডাকসু নির্বাচন যখন হয় তখন এমন একটা চিত্র বা চরিত্রের সৃষ্টি হয় যার সাথে জাতীয় রাজনীতি যুক্ত হয়ে পড়ে। আজকে যে ছাত্রটি তৃতীয় বর্ষে বা শেষ বর্ষে তার মাথার মধ্যে কাজ করে পাস করে সে চাকরি পাবে তো। ছাত্ররা আন্দোলন করার সময় তার চাকরির নিরাপত্তা চাইবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সে তো সরকারের কাছেই দাবি জানাবে। শিক্ষার একটা ভালো পরিবেশ তার দাবি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃতগৌরব সে যদি ফিরিয়ে আনতে চায়, ডাকসু বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারকে লাগবে। এ কারণেই জাতীয় রাজনীতি থেকে ডাকসু, ছাত্রদের নির্বাচন বলেন আন্দোলন বলেন কোনোভাবেই কোনো বিচ্ছিন্ন জিনিস নয়।
নয়া দিগন্ত : অন্যান্য দেশে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররা রাজনীতি সচেতন হয়ে কাজ করে?
মান্না : লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এখনো সারাপৃথিবীকে ওয়েলফেয়ার ইকোনমি, ওয়েলফেয়ার স্টেট শেখায়। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ সারাপৃথিবীকে জ্ঞানের আলো দেয়। আমাদের এখানে মুখথুবড়ে পড়া সংস্কার আন্দোলন এমনভাবে আটকে গেছে যে এটা কোথায় যায় কে জানে। এখানে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলতে যা বুঝাত তা থাকত তাহলে এটা কিন্তু একটা আলোর দিশারী হতে পারত। একটা আলোর বাতি, আলোর ঘর হতে পারত।
নয়া দিগন্ত : ডাকসু নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির ওপর কি প্রভাব ফেলতে পারে?
মান্না : ’৬৯-এর যে ডাকসু ছিল সেটি ইতিহাস বদলে দিয়েছে। ’৬৯-এর ডাকসু শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছে। কিন্তু আজকে কি হবে সেটা কনফিউজিং কোশ্চেন, কেনোনা, পরিস্থিতি যা বিরাজ করছে সেটা বিস্ময়কর। আমাদের সময় স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থী ডাকসুর ভিপি-জিএস তো দূরের কথা একটা হল সংসদে দাঁড়ানোর চিন্তা করত না। এতই বেশি পলিটিসাইজড ছিল বিষয়টা। এবং সবাই জাতীয় রাজনীতির কথা বলত। সত্তরের আগ পর্যন্ত তো শিক্ষা আন্দোলন, তারপর ৬ দফার আন্দোলন, শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলন এসব তো পরিপূর্ণভাবে রাজনীতি। স্বাধীনতার পর মুজিবের স্বৈরশাসন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সমস্ত সময় ওই ধরনের আন্দোলনের কারণে প্রার্থী যারা রয়েছে তার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, অ্যালাইনমেন্ট কি এগুলো সবাই বুঝতে চাইত। এখন দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিকদলগুলোর সাথে যারা জড়িত তারা ঘোষণা করছেন আমরা কোনো দল করি না, আমরা স্বতন্ত্র। যারা অন্যান্য রাজনৈতিকদলের সদস্য তারাও এভাবে আলাদা হয়ে গেলেন। তার মানে তারা জাতীয় রাজনীতি থেকে আলাদা হতে চাইছেন। এই নির্বাচনে যদি ছাত্রদল জেতে তাহলে বিএনপি একটা বিরাট লিড পাবে। আবার শিবির যদি জয়লাভ করে তাহলে তা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকে আরো প্রভাব সৃষ্টি করবে। এগুলো বাস্তব। মানুষের মধ্যে আরো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। আবার যারা পরাজিত হবে তাদের লস হবে মানুষ মনে করবে তাদের অতটা সমর্থন নেই। যেহেতু ছাত্ররা আমাদের দেশের সমাজ প্রগতি আন্দোলনের ভ্যানগার্ড তাই মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাই ডাকসুর ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমর্থন জোগাবে। একই সাথে জাতীয় রাজনীতিতে জুলাই সনদ, পিআর পদ্ধতি কি, এতে নির্বাচন হবে কি হবে না, সংস্কারের নানা বিষয় ডাকসুর মাধ্যমে ছাত্রদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে আবর্তিত হবে। তাদের চিন্তা ও মেধা এসব সঙ্কট মোকাবেলায় কাজ করবে। এ ব্যাপারে তারা জ্ঞানের আলো দিতে পারবে।
নয়া দিগন্ত : ডাকসুকে রাজনীতির বাইরে নেয়ার একটা সুপ্ত চেষ্টা তো রয়েছে বলে মনে হয়?
মান্না : হয়তো কেউ কেউ ভাবছেন ডাকসুকে রাজনীতি থেকে একটু বিযুক্ত করা যাবে, বেশ কিছুদিন থেকে তো, ‘উই হেট পলিটিক্স’ হ্যাশট্যাগ অথবা যেরকম করে বুয়েট করল ছাত্ররাজনীতি চলবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল রাজনীতি হবে না। এই ডাকসু নির্বাচনে রাজনীতি আরো বেশি স্পষ্ট হবে। আগামীতে রাজনীতি বিবেচনার বাইরে ডাকসু নির্বাচন হতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
এতবড় একটা গণ-অভ্যুত্থানের পর এবার পরিস্থিতিটা অন্যরকম। ডাকসুকে একটা বিরাজনীতির মধ্যে নিয়ে যাওয়া যায় কি না প্রথম দিক থেকে এ ধরনের একটা চেষ্টা লক্ষ্য করছি। ’৫২র ভাষা আন্দোলন ছাত্রদের অনেক বড় অর্জন হলেও তখন কিন্তু ডাকসু ছিল না। আবার ২৪এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় ডাকসু ছিল না। কিন্তু ছাত্ররাই এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলেন, একটা সাংস্কৃতিক কি অর্থনৈতিক আন্দোলন বলেন, তাত্ত্বিকভাবে বললেও ডাকসু হচ্ছে সবগুলো আন্দোলনের ভ্যানগার্ড। সাংস্কৃতিক বলেন আর অর্থনৈতিক বলেন ডাকসুর মধ্যে দিয়ে কিন্তু অনেকগুলো স্টার বেরিয়েছে। আমরা অনেক তারকা পেয়েছি।
নয়া দিগন্ত : ডাকসুকে বিরাজনীতিকরণের দিকে নেয়ার একটা প্রচেষ্টা কি আপনি দেখতে পান
মান্না : বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের ওপর আমার খুব একটা আস্থা নেই। দলের নাম করে প্যানেল দেয়া যাবে না, কোনো নেতার ছবি দেয়া যাবে না, কোনো নেতার কোটেশন দেয়া যাবে না, কোনো পোস্টারে যদি কোটেশন দেন সে নেতার নাম দেয়া যাবে না, অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা শুনছি, এতবড় একটা রক্তের নদী পাড়ি দিয়ে এই তীরে এসেছেন, ২৪ না হলে তো ২৫ আসত না। না হলে ডাকসু আসত না। ছাত্রদল হলে হলে কমিটি করেছে তার বিরুদ্ধে ডেমোস্ট্রেশন হয়ে গেল। ছাত্ররা তা করতেই পারে। হল বাদ দিয়ে ডাকসু হতে পারে না। ডাকসু কিন্তু শ্রমিকদের নির্বাচিত ট্রেডইউনিয়ন নয়। এটা সিবিএ নয়। ডাকসু ইজ অ্যান ইনস্টিটিউশন সিম্বল অব বাঙালিদের, বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক।