ডাকসুর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু, উৎসবমুখর ক্যাম্পাস

ব্যানার ফেলে দেয়া ও ছবি বিকৃতির প্রতিবাদ

মঙ্গলবার সকাল থেকেই টিএসসি, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও বিভিন্ন বিভাগের সামনে লিফলেট বিতরণ ও পরিচিতি সমাবেশে ক্যাম্পাস ছিল সরগরম।

হারুন ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Location :

Dhaka City
Printed Edition

প্রায় ৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫-এর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এই প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস জুড়ে তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। একই সাথে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কঠোর আচরণবিধি আরোপ করেছে। সকাল থেকেই টিএসসি, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও বিভিন্ন বিভাগের সামনে লিফলেট বিতরণ ও পরিচিতি সমাবেশে ক্যাম্পাস ছিল সরগরম। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী ভোট হবে ৯ সেপ্টেম্বর, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত।

নির্বাচনের নীতিমালা অনুযায়ী এবার ডাকসু প্রচার-প্রচারণায় সাদাকালো পোস্টারে কেবল প্রার্থীর নিজের ছবি ব্যবহার করা যাবে, অন্যকারো ছবি ব্যবহার করলে তা হবে আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো এক বার্তায় প্রার্থীদেরকে ডাকসু আচরণবিধির ৭নং ধারা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এতে বলা হয়, সাদা কালো পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ছাপানো ও বিলি করা যাবে। পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিলে কোনো প্রার্থী নিজের সাদাকালো ছবি ছাড়া অন্য কারো ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না।

আরো বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হল এলাকায় অবস্থিত কোনো প্রকার স্থাপনা, দেয়াল, যানবাহন, বেড়া, গাছপালা, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি বা অন্য কোনো দন্ডায়মান বস্তুতে পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল লাগানো যাবে না। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিলের ক্ষতি করা যাবে না। কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কোনো ছাত্র সংগঠন, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো কালি বা চুন বা কেমিক্যাল দ্বারা দেয়াল বা যানবাহনে কোনো লিখন, মুদ্রণ, ছাপচিত্র বা চিত্রাঙ্কন করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবে না।

যদিও বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চর্চার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ দেয়াল লিখন ও পোস্টারে দলীয় আদর্শের ধারক বাহক নেতাদের ছবির সাথে প্রার্থীরও ছবি রাখা। তাই এবার এই নিয়মকে ‘প্রথাবিরোধী’ বলেও মনে করছেন অনেকে।

তিন স্তরের নিরাপত্তা, মোতায়েন থাকবে সেনাবাহিনী : ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভোট গ্রহণ নির্বিঘœ করতে নির্বাচনের দিন তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে প্রবেশমুখে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৭টি পয়েন্টে স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ডাকসু ও হল সংসদের প্রার্থীদের সাথে এক আলোচনা সভায় এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, যারা নির্বাচন করছে তাদের মাথায় রাখা দরকার ডাকসু হচ্ছে সহশিক্ষা-কার্যক্রমের একটি অংশ। আমাদের প্রধান পরিচয় হচ্ছে আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে জ্ঞানচর্চা, গবেষণার মাধ্যমে এবং তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিক হিসেবে তৈরি করা। ফলে নির্বাচনটি হচ্ছে দেশের বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের একটি ধাপ। কোথাও কোনো কার্যক্রমের কারণে যেন মূল শিক্ষা কার্যক্রমে, শ্রেণী কার্যক্রমে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না হয়।

তিনি বলেন, প্রার্থীদের নির্বাচনী কোনো কার্যক্রমে যেন জুলাইয়ের শহীদদের কোনো প্রকার অসম্মান প্রদর্শন করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি কোনো প্রকার অসম্মানমূলক কাজ করা যাবে না। নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত থাকা সব শিক্ষক বা কর্মকর্তা কারো সাথে বেয়াদবি বরদাশত করা হবে না। কোনো প্রার্থীর অভিযোগ থাকলে সেটা আমাদের জানাতে হবে এবং আমরা ব্যবস্থা নেবো। কোনো প্রার্থী বা শিক্ষার্থী যদি কারো ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, পারিবারিক পরিচয় প্রদর্শন করে তবে তা গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করব। এসব নিয়ম যদি না মানা হয়, তবে প্রার্থিতা বাতিল করা হবে, এমন প্রচারণার বিধিমালা নিয়ে তিনি বলেন, সবপ্রার্থী তাদের নিজ পরিচয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালাতে পারবে। হলগুলোতে প্রচারণা চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট হলের প্রাধ্যক্ষ বরাবর অনুমতি নিতে হবে। কোনো লাইব্রেরি, রিডিংরুম পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটে এমন জায়গায় প্রচারণা চালাতে পারবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বক্তব্যের মাধ্যমে কাউকে বুলিং করতে পারবেন না। যদি করা হয়, তার বিরুদ্ধেও যথোপোযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নিরাপত্তা নিয়ে রিটার্নিং অফিসার বলেন, ভোটের দিন তিন স্তরের নিরাপত্তা থাকবে, প্রক্টরিয়াল বডি এবং বিএনসিসির সমন্বয়ে প্রথম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয় স্তরে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন কেন্দ্রে থাকবে, তৃতীয় স্তরে আর্মি থাকবে। মেইন ৭টি এন্ট্রি পয়েন্টে আর্মি অবস্থান নেবে।

চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ : ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায়

এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এবার ২৮টি পদে মোট ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সহসভাপতি (ভিপি) পদে ৪৫ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৯ জন এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ২৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

এ ছাড়াও বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী রয়েছেন : মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ১৭ জন, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ১১ জন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে ১৪ জন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১৯ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১২ জন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১৩ জন, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১২ জন এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৭ জন। সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ২১৭ জন প্রার্থী।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রচারণা শুরু ছাত্রদলের : মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শহীদ ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিবেদনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাবির ভিসি চত্বরে অবস্থিত স্মৃতি চিরন্তনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন ছাত্রদলের প্যানেলের নেতাকর্মীরা।

এ সময় ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, আমরা প্রতিশ্রুতি নয় বরং পরিবর্তনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আগামী ডাকসু বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, আমরা সবসময় মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করি। একই ভাবে জুলাইকেও আমরা ধারণ করি। আমরা প্যানেল ঘোষণার পর সর্বপ্রথম জুরাইন কবরস্থানে জুলাই শহীদ আনাসের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। একইভাবে, আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করছি।

ঢাবিকে পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে একটা অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করতে চাই : সাদিক

ডাকসুর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণার শুরুতেই ঢাবিকে পলিটিক্যাাল ইনস্টিটিউট থেকে শিক্ষার্থীবান্ধব অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিলেন ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম।

গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচনী প্রচারণার অনুমতি পাওয়ার পর ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে জোহরের নামাজ আদায়ের পর মসজিদ প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

সাদিক বলেন, প্রতিটি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে বিশাল স্বপ্ন নিয়ে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চায় কেউ বা চায় সরকারি আমলা হয়তে। রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চার ফলে রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের বিমুখতা তৈরি হয়। আমরা যদি সোস্যাল মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা ছড়ানোসহ বিভিন্ন ট্যাগিং ও ফেমিংয়ের রাজনীতি করি তাহলে যারাই এ ধরনের কাজ করবে শিক্ষার্থীরা তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। এ সময় তিনি ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানান। সম্মেলনে ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম ছাড়াও শিবির প্যানেলের আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রার্থী এস এম ফরহাদ (জিএস) ও মহিউদ্দিন খানসহ (এজিএস) অন্য সম্পাদক প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রচারণার প্রথম দিনেই শিবিরের ফেস্টুন ফেলে দিলো দুর্বৃত্তরা : নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে। প্রার্থীরা ব্যানার ও ফেস্টুন লাগিয়ে নিজেদের প্রচার করছেন। তবে প্রচারণার প্রথম দিনেই চারুকলা অনুষদে ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে।

গতকাল সকালে শিবির সমর্থিত এই জোট ব্যানার টাঙিয়ে প্রচারণা শুরু করে। কিন্তু চারুকলা অনুষদে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেলের ছবি সংবলিত ফেস্টুনটি টাঙানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি ফেলে দেয়া হয়। যদিও এ ঘটনায় কারা জড়িত, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী বলেছেন, আমরা এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ব্যানার ফেলে দেয়া ও ছবি বিকৃতির প্রতিবাদ ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের : আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ব্যানার মাটিতে ফেলে দেয়া এবং এক নারী প্রার্থীর ছবি বিকৃত করার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা এ ঘটনাকে নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে একটি ‘কুচক্রী মহলের’ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে।

গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট জানায়, তারা নির্বাচন কমিশনের সব বিধিমালা মেনে ক্যাম্পাসে ব্যানার স্থাপন করেছিল। কিন্তু একটি ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের ব্যানার ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। একই সাথে জোটের কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী সাবিকুন নাহার তামান্নার বোরকা পরিহিত ছবি বিকৃত করে তারা পূর্বের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।