হাসিনা জয় পুতুলকে ২১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড

পূর্বাচলের প্লট লুট : রাষ্ট্রের জমি দখলের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ

আদালত প্রতিবেদক
Printed Edition
হাসিনা জয় পুতুলকে ২১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড
হাসিনা জয় পুতুলকে ২১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড

  • শেখ হাসিনা (২১)বছর সশ্রম কারাদণ্ড৩ লাখ টাকা জরিমানা
  • সজীব ওয়াজেদ জয়(৫)বছর সশ্রম কারাদণ্ড১ লাখ টাকা জরিমানা
  • সায়মা ওয়াজেদ পুতুল(৫)বছর সশ্রম কারাদণ্ড১ লাখ টাকা জরিমানা

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লট দখলের অভিযোগে দায়ের হওয়া তিনটি দুর্নীতি মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ আদালত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ মোট ২২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন।

রায়ে প্রকাশ পেয়েছে- কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গৃহায়ন মন্ত্রণালয় ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে রাষ্ট্রের জমি কার্যত ‘পারিবারিক সম্পদে’ পরিণত করেছিল।

আদালতের পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও পারিবারিক অধিকার : আদালত সূত্র জানায়, শেখ হাসিনাকে তিনটি পৃথক মামলায় সাত বছর করে মোট ২১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একই সাথে অর্থদণ্ড অনাদায়ে অতিরিক্ত কারাবাসের আদেশ দেয়া হয়েছে।

রায়ে আদালত উল্লেখ করেন,‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি জমিকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পত্তির মতো ব্যবহারের প্রবণতা এই মামলায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।’ তদন্তে উঠে আসে, শুধু রাজনৈতিক নির্দেশ নয়- প্রশাসনিক ফাইলে একের পর এক ‘বিশেষ সুবিধা’ সৃষ্টি করা হয়েছিল তাদের নামে। একাধিক সাক্ষীর বক্তব্যে উঠে এসেছে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ‘উপর মহলের নির্দেশে’ এসব বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হয়েছিল।

রায় : ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো: আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এই রায় ঘোষণা করেন। মামলায় ২৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। পরে আদালত রায় ঘোষণার এদিনের তারিখ ধার্য করেন। সে অনুযায়ী গতকাল রায় দেয়া হয়।

পৃথক এই তিন মামলায় আসামি ৪৭ জন। তবে ব্যক্তি হিসেবে এই সংখ্যা ২২। ১৭ নভেম্বর পৃথক এই তিন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। এর আগে গত ৩১ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।

কিভাবে রাষ্ট্রীয় জমি ব্যক্তি সম্পত্তিতে রূপান্তর : মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী-ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডে অবস্থিত তিনটি ১০ কাঠার প্লট (মোট ৩০ কাঠা) নিজেদের নামে বরাদ্দ নেন, যদিও তারা কেউই আইন অনুযায়ী বরাদ্দের যোগ্য ছিলেন না। এটি ছিল একটি সংগঠিত রাষ্ট্রীয় স্তরের অপারেশন, যেখানে রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সমন্বিতভাবে নিয়ম ভেঙে প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করেন।

দণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকা

ব্যক্তি সাজা

শেখ হাসিনা ৭+৭+৭ = ২১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, ৩ লাখ টাকা জরিমানা

সজীব ওয়াজেদ জয় ৫ বছর সশ্রম, ১ লাখ টাকা জরিমানা

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ৫ বছর সশ্রম, ১ লাখ টাকা জরিমানা

সালাহউদ্দিন (সাবেক পিএস) ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড

শরীফ আহমেদ (সাবেক প্রতিমন্ত্রী) ১৮ বছর কারাদণ্ড

শহীদ উল্লা খন্দকার (সাবেক সচিব) ১৮ বছর কারাদণ্ড

কাজী ওয়াছি উদ্দিন ১৮ বছর কারাদণ্ড

(মোট ২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা)

একজন মাত্র আসামি খুরশীদ আলম আগে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান। বাকিরা দীর্ঘদিন পলাতক।

তদন্তে উঠে আসে ‘ক্ষমতার সিন্ডিকেট’ কাঠামো : দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা আফনান জান্নাত কেয়া আদালতে যে চিত্র তুলে ধরেন তা ছিল স্পষ্ট। এই প্লট বরাদ্দ কোনো ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ নয়, বরং ছিল একটি পরিকল্পিত পারিবারিক-রাষ্ট্রীয় সিন্ডিকেট। রাজউক কর্মকর্তারা চাপের মুখে ফাইল ছাড় করেছেন, সচিবালয় অনুমোদন দিয়েছে, আর পুরো ব্যবস্থাটি পরিচালিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে।

আদালতে অনুপস্থিত, অনুতাপহীন, পলাতক : পতন পরবর্তীতে সব মামলার প্রধান অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ পরিবারের সদস্যরা বিচারিক প্রক্রিয়ায় কখনো উপস্থিত হননি। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর রয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগও তারা গ্রহণ করেননি।

এই প্লট মামলার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো- সরকারি দফতরগুলো নিজেরাই ছিল এই দুর্নীতির ‘কারিগরি বাহিনী’।

যেসব কর্মকর্তাদের দণ্ড দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রযেছেন- রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান, একাধিক সাবেক সদস্য, গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অতিরিক্ত সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব। রায়ে আদালত বলেন ‘এই দুর্নীতি কোনো একক ব্যক্তির নয়, এটি ছিল একটি সংগঠিত প্রশাসনিক চেইন।’

কিভাবে হয়েছিল প্লট ম্যানিপুলেশন : তদন্তে পাওয়া যায়, একই ধরনের কৌশল বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। নিয়মের ব্যতিক্রম দেখানো; জাল নথি তৈরি; ফাইল নোটিংয়ে ‘বিশেষ অনুমোদন’ যুক্ত করা; প্রকৃত প্রাপকদের বাদ দিয়ে ‘নির্ধারিত নাম’ ঢোকানো- এটি ছিল এক ধরনের ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তিগতকরণের নীরব মডেল’।

৩ মামলায় উঠে এসেছে :

  • আবেদনপত্র হয়েছিল পরে, বরাদ্দ ছিল আগে
  • ফাইলে তারিখ-স্বাক্ষর কারসাজির প্রমাণ
  • সাক্ষীরা আদালতে স্বীকার করেছেন, তারা ‘উপর থেকে চাপ’ পেয়েছিলেন
  • টাকার উৎস ও লেনদেন নিয়ে তদন্তে অসঙ্গতির প্রমাণ মিলেছে

প্রশ্ন উঠছে, এটা বিচ্ছিন্ন দুর্নীতি, নাকি ‘রাষ্ট্রীয় লুট মডেল’? এ ছাড়া এই রায়ের পর বড় প্রশ্ন এখন জনমনে, এটি কি শুধু তিনটি মামলার ঘটনা? নাকি পুরো শাসনামলে একই মডেলে হাজার হাজার প্লট বরাদ্দ হয়েছে? এই চক্রে আর কারা ছিল? দুদক কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এটি ছিল ‘আইসবার্গের শুধু চূড়া’।

সামনে আরো রায় : ছয়টি মামলার মধ্যে ৩টির রায় হয়েছে। বাকি ৩টির রায় ১ ডিসেম্বর ঘোষণা হবে। সেসব মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন- টিউলিপ সিদ্দিক (ব্রিটিশ এমপি), রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক। এই রায় শুধু একটি দুর্নীতি মামলার রায় নয়; এটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে পারিবারিক সম্পদের যন্ত্রে পরিণত করার একযুগের প্রতীকী পতন। পূর্বাচল প্রকল্প ছিল মূলত জনগণের জন্য, কিন্তু তা পরিণত হয়েছিল ক্ষমতাসীন পরিবারের জন্য ‘ব্যক্তিগত ব্যাংক ভল্টে’।