রাজউকের তদন্তে ‘দোষের প্রমাণ’ তবু অব্যাহতি!

চেয়ারম্যানের বাংলো সংস্কারে অনিয়ম স্বীকার, বিতর্কিত দায়মুক্তি

মৌখিক আদেশে ঠিকাদার নিয়োগ ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কথা সরকারি তদন্তেই স্বীকার করা হয়েছে তবু অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে ‘সন্তোষজনক জবাব’ দেখিয়ে অব্যাহতি দিয়েছে রাজউক। সরকারি স্মারক ও তদন্ত সুপারিশে গুরুতর প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমাণ থাকার পরও দায়মুক্তির এই সিদ্ধান্ত নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে : তাহলে তদন্তের উদ্দেশ্য কী- দায় নির্ধারণ, না ধামাচাপা?

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

রাজউক চেয়ারম্যানের সরকারি বাংলো সংস্কারে দরপত্র ছাড়াই কাজ শুরু, মৌখিক আদেশে ঠিকাদার নিয়োগ ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কথা সরকারি তদন্তেই স্বীকার করা হয়েছে তবু অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে ‘সন্তোষজনক জবাব’ দেখিয়ে অব্যাহতি দিয়েছে রাজউক। সরকারি স্মারক ও তদন্ত সুপারিশে গুরুতর প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমাণ থাকার পরও দায়মুক্তির এই সিদ্ধান্ত নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে : তাহলে তদন্তের উদ্দেশ্য কী- দায় নির্ধারণ, না ধামাচাপা?

৩০ লাখের কাজ কিভাবে ২ কোটির বেশি হলো?

তদন্ত সংশ্লিষ্ট নথি অনুযায়ী, রাজউক চেয়ারম্যানের সরকারি বাংলো বসবাসযোগ্য করার জন্য প্রথম দফায় মাত্র ৩০ লাখ টাকার একটি প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু কোনো উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই কাজ শুরু হয়ে যায়।

পরবর্তীতে কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর হঠাৎ করে নতুন প্রাক্কলন করা হয়, যেখানে ব্যয় দেখানো হয় :

প্রথম প্রাথমিক প্রাক্কলন : ২,১৮,১০,৮৫৫ টাকা

চূড়ান্ত অনুমোদিত প্রাক্কলন : ২,১৬,৫৭,৫৬৪ টাকা

অর্থাৎ বাস্তবে কাজ শুরু হয় কম টাকায়, কিন্তু বৈধতার মোড়কে ঢাকতে গিয়ে ব্যয় দেখানো হয় প্রায় ৯ গুণ বেশি।

দরপত্র ছাড়াই ঠিকাদার নিয়োগ- মৌখিক নির্দেশের খেলা

তদন্ত কমিটির সরেজমিন তথ্য অনুযায়ী-

কাজ শুরু হয় মার্চ ২০২৪-এ

কোনো লিখিত আদেশ, অনুমোদিত নকশা বা দরপত্র ছাড়াই

কাজ পায় ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (ঘউঊ) নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান

মৌখিক নির্দেশ দেন-

মোস্তাক আহমেদ (প্রধান নগর স্থপতি)

রাহাত মুসলেমীন (প্রকল্প পরিচালক)

পরবর্তীতে লোকদেখানো নিয়ম রক্ষায় ই-জিপি দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন কাজ প্রায় শেষ।

এক দরদাতার নাটকীয় দরপত্র!

দরপত্র ডাকা হলেও সেখানে অংশ নেয় মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান- মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স।

তাদের প্রস্তাবিত দর ছিল :

১,৯৪,১১,৮০৮ টাকা

যা সরকারি প্রাক্কলনের চেয়ে ১০% কম

কিন্তু বাস্তবে বড় অংশের কাজ আগেই অন্য ঠিকাদার দ্বারা সম্পন্ন হয়ে যায়।

প্রাক্কলন বনাম বাস্তব কাজ : ভয়াবহ গরমিল

তদন্তে বেরিয়ে আসে-

কাজের ধরন প্রাক্কলনে ধরা বাস্তবে পাওয়া গেছে

স্যুয়ারেজ ইনস্পেকশন পিট ৬৫ টি ৩১ টি

পিট কভার ৬৫ টি ৩১ টি

ওয়াটার প্রুফিং এলাকা ৪৩৪.৭৪৬ বর্গমিটার ৩৪১.৭৭ বর্গমিটার

অর্থাৎ কাগজে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ৩৪টি পিট বেশি দেখানো হয়েছে

কাজ না করেও প্রাক্কলনে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে

তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে-

‘আর্থিক সাশ্রয় ও কৃচ্ছ্রতা নীতি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।’

সরকার স্বীকার করেছে : ‘নিয়ম ভেঙে কাজ শুরু করা হয়েছে’

রাজউকের স্মারক (তারিখ : ২১ অক্টোবর ২০২৫) ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- প্রাক্কলন অনুমোদন ও টেন্ডার আহ্বানের আগেই একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে, ফলে রাজউকের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

এটি সরাসরি সরকারি ক্রয় বিধিমালা (চচজ) লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’- সরকারি নথিতেই উল্লেখ

তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে আরো বলা হয়েছে-

একই ঠিকাদারকে অন্য চলমান প্রকল্প থেকে এনে বাংলো সংস্কারে নিয়োগ করা হয়েছে তা হয়েছে মৌখিক নির্দেশে এতে স্বাভাবিকভাবেই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট সৃষ্টি হয়েছে এটি ‘আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী’

অর্থাৎ বিষয়টি শুধু প্রশাসনিক নয়- সরাসরি নৈতিক ও আর্থিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের অভিযোগ।

তার পরও ‘সন্তোষজনক জবাব’! কী ছিল সেই জবাব?

এসব গুরুতর মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) এ বি এম এহছানুল মামুন স্বাক্ষরিত স্মারকে বলা হয়-

‘কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক বিবেচনা করত অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি প্রদান করা হলো।’

কিন্তু-

সেই জবাব কী ছিল?

কী ভিত্তিতে ‘সন্তোষজনক’ ধরা হলো?

তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের সাথে এই অব্যাহতির কোনো মিল আছে কি না?

এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর স্মারকে নেই।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ যা আদৌ বাস্তবায়িত হয়নি

তদন্ত প্রতিবেদনের ৯ নম্বর সুপারিশ অংশে যা বলা হয়েছিল :

১) দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা

২) মৌখিক আদেশে ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ

৩) বিল পরিশোধের আগে কাজের গুণগত মান যাচাই

৪) বড় ব্যয়ে মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন বাধ্যতামূলক করা

৫) কৃচ্ছ্রতা নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে-

ব্যবস্থা নেয়ার বদলে অব্যাহতি

নিয়ম সংস্কারের বদলে নীরবতা

বিশ্লেষণ : তদন্ত কি আত্মরক্ষার ঢাল?

প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ক্ল্যাসিক ‘ইনস্টিটিউশনাল কভার-আপ’-এর নমুনা হতে পারে।

স্পষ্ট দু’টি বিপরীত সত্য :

সরকারি তদন্তে বলা হলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো

নিয়ম ভেঙে কাজ শুরু দায়মুক্তি

স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ অভিযোগ প্রত্যাহার

কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট ‘সন্তোষজনক জবাব’

এখানে প্রশ্ন উঠছে-

তদন্ত কি সত্য উদঘাটনের জন্য, নাকি দায় এড়ানোর পথ তৈরি করতে?

ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে কেন প্রশাসনিক ন্যায়বিচার বারবার দুর্বল হয়ে পড়ে?

এ ঘটনাটি শুধু একটি বাংলো সংস্কারের গল্প নয়। এটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শাস্তিমূলক সংস্কৃতির বড় সঙ্কটের প্রতিচ্ছবি।

প্রশ্ন এখন একটি নয়; যখন সরকারি নথিতেই অনিয়ম স্বীকার করা হয়, তখন দায়মুক্তি দেয় কে?