ঝুঁকিপূর্ণ ১১ দিন

নিরাপত্তা চাদরে রাজধানী

১৪৬টি চেকপোস্ট, হোটেল ছাত্রাবাসে অভিযান, বাড়তি পুলিশ মোতায়েন: সরকারবিরোধী কর্মসূচি ঘিরে ‘নাশকতার’ আশঙ্কা; মাঠে পুলিশ-গোয়েন্দা ইউনিট

পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে পাঠানো একটি গোপন বার্তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সহিংসতা বা নাশকতার আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে ডিএমপি এবং অন্যান্য ইউনিট।

আমিনুল ইসলাম
Printed Edition
রাজধানীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশি
রাজধানীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশি |ফাইল ফটো

২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে ‘বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ’ বিবেচনা করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থায় ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি করেছে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে সম্প্রতি পাঠানো একটি গোপন বার্তার ভিত্তিতে এই সময়কালে রাজনৈতিক সহিংসতা বা নাশকতার আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং অন্যান্য ইউনিট।

ডিএমপি কমিশনারের নেতৃত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক অনলাইন মিটিংয়ে জানানো হয়, রাজধানীর প্রতিটি বিভাগে দুই প্লাটুন করে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি, মোবাইল পেট্রোল, রাতভর চেকপোস্ট, হোটেল ও ছাত্রাবাসে অভিযান চালানোর পাশাপাশি ‘ভার্চুয়াল স্কোয়াড’-এর ওপরও সাইবার গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগকে ঘিরেই গোয়েন্দা সতর্কবার্তা : এসবির বিশেষ সতর্কবার্তায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ এবং তার ছাত্র ও যুব সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী ছদ্মবেশে রাজধানীতে অবস্থান নিয়ে সহিংসতা বা নাশকতার পরিকল্পনা করতে পারে। বিশেষ করে ঐতিহাসিক ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলো যে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে, তাকে পেছন থেকে বাধাগ্রস্ত করতেই ‘ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে’ এমন তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে।

এসবির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের কিছু সক্রিয় কর্মী দেশ ও বিদেশ থেকে ‘ভার্চুয়াল স্কোয়াড’ গড়ে তুলে সামাজিক মাধ্যমে উসকানিমূলক ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউব এবং টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে তারা নানাভাবে জনমনে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

বাড়তি নিরাপত্তায় ঢাকায় ১৪৬ চেকপোস্ট : ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ৩১ জুলাই রাত থেকে রাজধানীতে ১৪৬টি স্থায়ী ও অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি থানাকে নিজস্ব এলাকায় গেট কন্ট্রোল ও কমপাউন্ড নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়েছে। প্রত্যেক থানায় ডিউটিরত পুলিশ সদস্যদের অস্ত্রসহ সজাগভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ডিএমপির এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, থানা চত্বরে ককটেল বা বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য নিক্ষেপের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রতিটি প্রবেশপথে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন, গেট কন্ট্রোল ও সন্দেহভাজনদের ওপর অতিরিক্ত নজরদারি চালানো হচ্ছে।

অভিযান হোটেল ও ছাত্রাবাসে : নির্দেশনায় আবাসিক হোটেল, বিশেষ করে পুরান ঢাকা, ফকিরাপুল, মিরপুর, শ্যামলী, আদাবরের কমদামি হোটেল ও ছাত্রাবাসগুলোতে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশের ভাষায়, ‘নাশকতাকারীরা পাঁচতারকা হোটেলে ওঠে না; বরং কমদামি হোটেলেই লুকিয়ে থাকে।’

এছাড়া ঢাকায় আগত সন্দেহভাজনদের নজরে রাখতে বাসটার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

বিশেষ সতর্কতা জারি, মাঠে মোবাইল পেট্রোল ও গোয়েন্দা ইউনিট : ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ‘বিশেষ অভিযান’ পরিচালনার অংশ হিসেবে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও সন্দেহভাজন যানবাহনে তল্লাশি চলছে। সারা দেশে পুলিশের ইউনিটগুলোকে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল, মোবাইল পেট্রোল, সাইবার পেট্রোলিং ও গোয়েন্দা নজরদারি তীব্র করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীর বাইরে থেকেও বিভিন্ন গ্রুপ ঢাকায় নাশকতার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করতে পারে, এজন্য ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলোর ওপর বিশেষ নজরদারি চালানো হচ্ছে।

‘জুলাই অভ্যুত্থান’ ও রাজনৈতিক উত্তেজনা : পুলিশের গোপন বার্তায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে চলমান সরকারবিরোধী কর্মসূচি ও ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিল-সমাবেশগুলোতে ‘চোরাগোপ্তা হামলা’ বা ‘উসকানি’ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থির করার চেষ্টা করতে পারে বলেও বার্তায় সতর্ক করা হয়েছে।

ঢাকার বাইরেও, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কয়েকটি অঞ্চলে এই সময়কালে সহিংসতার চেষ্টা হতে পারে বলে গোপন প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে।

প্রশাসনের বক্তব্য : ‘গুরুত্ব দিচ্ছি না, তবে সতর্ক আছি’

ডিএমপির জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টিকে আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছি না। আমাদের কাছে বড় ধরনের নাশকতার সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য নেই। তবে সতর্ক অবস্থানে আছি, যাতে হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা যায়।’

অপরদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, “জুলাই-আগস্ট পুরো সময়টাই রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। তবে ১১ দিনের নির্দিষ্ট ‘বিশেষ সতর্কতা’ জারি নিয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানি না।”

নিরাপত্তার ছায়ায় এক সপ্তাহ : যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই অভিযান ও প্রস্তুতিকে ‘রুটিন নিরাপত্তা জোরদার’ হিসেবে উপস্থাপন করছে, বাস্তবতা হলো ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মাঠের উত্তাপ, সরকারের বিরোধিতাকারী শক্তির কর্মসূচি এবং নিষিদ্ধ সংগঠনের তৎপরতা একটি জটিল সমীকরণ তৈরি করেছে।

এই সময়ের মধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশে কোনো বড় ধরনের সহিংসতা না ঘটলেও পুলিশি প্রস্তুতি, নজরদারি ও নিরাপত্তা ঘিরে এক ধরনের চাপ ও উদ্বেগ অনুভব করছেন সাধারণ নগরবাসীও। দেখা যাক, নিরাপত্তার এই ছায়া ঢাকা শহরের স্বস্তি বজায় রাখতে পারে কি না।