শব্দের মারপ্যাঁচে এলজিবিটি হাইইন্টেলেকচুয়ালিটি হয়ে গেছে

সাক্ষাৎকার : ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন

ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেনইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড লাইফ সায়েন্স-ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক।

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন
ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন

ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন বলেছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে অত্যন্ত গোপনে যেভাবে এলজিবিটি আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছে এর শিকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে বাংলাদেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি বলেন শুধু জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে নয় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এলজিবিটি এক ভয়ঙ্কর ও আগ্রাসী শক্তি হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। জুলাই আন্দোলনের পর আমরা এলজিবিটি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে পারছি। তারপরও আমাদের হত্যার হুমকি আসছে। শব্দের মারপ্যাঁচে এলজিবিটি অনেক হাই ইন্টেলেকচুয়ালিটির অন্তর্গত হয়ে গেছে।

ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড লাইফ সায়েন্স-ডিসিপ্লিনের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, সুশীলসমাজের বামধারার একটি অংশ আমরা যারা এলজিবিটির বিরুদ্ধে লড়ছি তাদেরকে ব্লেম দিচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি নৈতিক ভিত্তি থেকে এলজিবিটি আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। সাংস্কৃতিক কর্মীরাও লিবারেল হিসেবে এলজিবিটি আন্দোলনকে প্রমোট করছে। এখানে যে মূল্যবোধ রিলেটেড, নৈতিকতা বা সমাজকে শ্রদ্ধা করে ওই ধরনের সাংস্কৃতিক ফোরাম এলজিবিটি নিয়ে সোচ্চার নয়। এ জন্য তারা আইডেন্টিফাই করেছে কারা ক্রিটিক্যালি বিষয়টি জানে। সেই হিসেবে আমরা টার্গেট। নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন গত ২৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা এবং বায়োমেডিক্যাল ও জনস্বাস্থ্য সেক্টরে গবেষণার সাথে যুক্ত। ড. হোসেন সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। এরপর তিনি ডুকে-নাস গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল স্কুল এবং সিঙ্গাপুর ক্যান্সার সেন্টারে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে বায়োটেক ডিভিশনের সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ওলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ে অনারারি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। ড. হোসেন গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থ্যালাসেমিয়া, শিশুদের স্থূলতা, ডেঙ্গু এবং ক্যান্সারের মতো অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণা করছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, এবং সামাজিক মূল্যবোধ বিষয়ে তিনি প্রায় তিন দশক ধরে লেখালেখি করছেন। তার উল্লেখযোগ্য চারটি বই হচ্ছে ‘সন্তান প্রতিপালনে এ যুগের চ্যালেঞ্জ’, ‘বিসিএস নাকি বিদেশে উচ্চশিক্ষা?’ ‘সমতার আড়ালে সমকামিতা মিশন’ এবং ২৪ গণ-অভ্যুত্থান ইতিহাসের প্রামাণ্য সংকলন ‘শহীদদের শেষ মুহূর্তগুলো’।

নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশে কিভাবে এলজিবিটি আন্দোলনের সূচনা হলো?

ড. হোসেন : ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলন শুরু হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। এটার হুমকি বহুমুখী। জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি বড় হুমকি কারণ এইচআইভি, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগ সমকামীদের মধ্যে বেশি। তাদের অপরাধ প্রবণতা অনেক বেশি। বিভিন্ন কারণে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। এ জন্য সেলফার্ম, সুইসাইড, এডিকশন, পেডুফেলিয়া এগুলো হলো তাদের কমন বৈশিষ্ট্য। তাদের কার্যক্রম সামাজিক ও পরিবারবিরোধী। পরিবার ছাড়া সমাজ টিকে থাকতে পারে না। সন্তান জন্মদান ও বংশধারা বজায় রাখার বিরোধী এ মতবাদ বিধ্বংসী অপরাধ। ইনডিভুয়াজিল স্টিক, যা বিরাট সমস্যা আকারে ধারণ করেছে। এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পালে সমাজের যত আইন কানুন সব ব্রেকডাউন করবে। ট্রান্সজেন্ডার হচ্ছে সমকামিতার এক্সট্রিম ভার্সন।

নয়া দিগন্ত : কিভাবে এটা মোকাবেলা করা যায়?

ড. হোসেন : এলজিবিটি মোকাবেলায় আমাদের আইনের ৩৭৭ ধারাকে বলবৎ রাখতে হবে। সমকামিরা এ আইনকে ভাঙার চেষ্টা করছে। সমস্যা হচ্ছে শব্দের মারপ্যাঁচ দিয়ে সব সংস্কার পলিসিতে এবং সিএলও এবং আইএলও সি ওয়ান নাইনটিন রেটিফিকেশন হয়েছে। এটার মাধ্যমে বায়াররা টেক্সটাইল মালিকদের চাপ দিতে পারবে যে ইনক্লুসিভ এনভায়রনমেন্ট বানাও। শব্দের এমন ব্যবহার করে আইনিভাষা এভয়েড করতে পারে। এ ধরনের শব্দগত বিষয় আমাদের মূল্যবোধে আঘাত হানছে। এ জন্য শব্দগুলোকে আইনের ভেতর স্পেসিফিক করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা জেন্ডারের সাথে লিংক নাই এ ধরনের ইস্যুগুলো আসতে হবে। এটা মোকাবেলা এককভাবে সম্ভব না, রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা হতে হবে।

নয়া দিগন্ত : অন্য কোনো দেশ কিভাবে এলজিবিটি মোকাবেলা করছে?

ড. হোসেন : মালয়েশিয়াতে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এ ধরনের সমকামী বা তাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। জুন মাসে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি থাকে। এক ধরনের রংধনু জাতীয় ঘড়ি পাঁচ ব্যান্ডের যা সমকামীদের প্রতীক তা কেনা নিষিদ্ধ। যে এ ধরনের ঘড়ি কিনবে তার তিন বছরের জেল দেয়া হয়। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন এলজিবিটি হচ্ছে ফ্যাসিজম। কারণ এটা হচ্ছে গ্লোবাল এজেন্ডা। পরিবেশ বিনষ্ট হবে।

চীনের মতো দেশে লেসবিয়ানিজম বা এলজিবিটির পক্ষে নিবন্ধ লেখার কারণে এক লেখিকাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাশিয়ায় এলজিবিটির বিস্তার ঘটলে জনসংখ্যা কমে যাবে এই আশঙ্কায় সমকামী আন্দোলনকে চরমপন্থী ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ এ ধরনের আন্দোলনে পরিবেশ স্ট্রাকচার ধ্বংস হবে। দেশটিতে এমনিতে জন্মগ্রহণের হার কমে যাচ্ছে। রাশিয়ায় এলজিবিটির বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

নয়া দিগন্ত : পশ্চিমা দেশগুলো কি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসেবে এলজিবিটি আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছে বা সমর্থন করছে? বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে জনসংখ্যার স্বাভাবিক হার যাতে না হয় বা এ হারে ধস নামানোর অপচেষ্টা হিসেবে এ ধরনের আন্দোলনের পেছনে কি তারা দাঁড়িয়ে গেছে?

ড. হোসেন : এলজিবিটি একটি সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধুয়া দিয়ে এলজিবিটি সমর্থন করছে পশ্চিমা দেশগুলো। আমাদের দেশে মানবাধিকার ও পশ্চিমাদেশগুলোর মানবাধিকার আলাদা। ২০১১ সালে জাতিসঙ্ঘে ভোটাভুটির মাধ্যমে মানবাধিকারের সঙ্ঘা পরিবর্তন করা হয়েছে। মানবাধিকারের মধ্যে এলজিবিটি অন্তর্ভুক্ত করার ওই সময় ওআইসির সদস্য মুসলিম দেশগুলো ওয়াকআউট করেছিল। বাংলাদেশও ওয়াকআউট করেছিল। বিষয়টি নিয়ে জাতিসঙ্ঘে অনেক বিতর্ক, হট্টগোল, হাতাহাতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো আমাদের দেশের মিডিয়া প্রচার করেনি।

বাংলাদেশে এলজিবিটি মুভমেন্ট শুরু হয়েছে মিডিয়ার মাধ্যমে। মিডিয়া কর্মীদের এলজিবিটি নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, পুরস্কার দেয়া হয়েছে। একটি এনজিও দুই হাজার আইনজীবীকে এলজিবিটি নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ওই এনজিওটি এলজিবিটি নিয়ে অ্যাক্টিভলি ইনভলবড। এলজিবিটির বিপক্ষে যায় এমন খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয় না।

নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিকভাবে এটিকে কিভাবে মোকাবেলা করা যায়?

ড. হোসেন : যেহেতু এটি মূল্যবোধের ইস্যু, সামাজিক ও পারিবারিক ইস্যু এবং রাজনীতি করা হয় সমাজের ভালর জন্য, তো এলজিবিটি যদি রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখা না হয় তাহলে একটা সময়ে মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাবে। রাজনীতিবিদরা যদি বলত যে এলজিবিটি চান না তাহলে এ ধরনের আন্দোলন কখনই বাংলাদেশে সম্ভব হতো না।

নয়া দিগন্ত : সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবীকে এলজিবিটি নিয়ে কি ধরনের ধারণা পোষণ করছেন বলে মনে হয়?

ড. হোসেন : এখন সুশীলসমাজ কারা, সুশীলসমাজের বামধারার একটি অংশ আমরা যারা এলজিবিটির বিরুদ্ধে লড়ছি তাদেরকে ব্লেম দিচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি নৈতিক ভিত্তি থেকে এলজিবিটি আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। সাংস্কৃতিক কর্মীরাও লিবারেল হিসেবে এলজিবিটি আন্দোলনকে প্রমোট করছে। এখানে যে মূল্যবোধ রিলেটেড, নৈতিকতা বা সমাজকে শ্রদ্ধা করে ওই ধরনের সাংস্কৃতিক ফোরাম এলজিবিটি নিয়ে সোচ্চার নয়। জুলাই আন্দোলনের পর আমরা এলজিবিটি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে পারছি। তারপরও আমাদেরকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। শব্দের মারপ্যাঁচে এলজিবিটি অনেক হাই ইন্টেলেকচুয়ালিটির অন্তর্গত হয়ে গেছে। এ জন্য তারা আইডেন্টিফাই করেছে কারা ক্রিটিক্যালি বিষয়টি জান। সেই হিসাবে আমরা টার্গেট। এলজিবিটির বিরুদ্ধে কথা বলায় দুই শিক্ষককে প্রকাশ্যে হত্যার প্ররোচনার পর ২৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

নয়া দিগন্ত : মসজিদের ইমামরা তো এর বিরুদ্ধে মানুষকে সাবধান করতে পারেন

ড. হোসেন : অবশ্যই। তারাই আসলে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। খুৎবায় বা ওয়াজে তারা এ বিষয়টি নিয়ে বলতে পারেন। সামাজিক আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এলজিবিটি কিভাবে বিস্তার করছে সে সম্পর্কে তারা জানেন না। নীরবে ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটছে এ আন্দোলনের যা তারা টের পাচ্ছেন না। শব্দের মারপ্যাঁচ সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। অন্তর্ভুক্তি বললে সবাই বলবে এটা তো ভালো জিনিস কিন্তু অন্তর্ভুক্তির মধ্যে যে এলজিবিটি ঢুকে আছে, যৌন সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের চিত্রিত করা হচ্ছে এবং দুঃখজনকভাবে অনেক আলেম ওলামারাও না জেনে না বুঝে তাদের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। এখানে আমাদের বড় ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ফারাক আছে।

নয়া দিগন্ত : তারমানে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের প্রয়োজন আছে?

ড. হোসেন : বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক দুই ফ্রন্টেই এলজিবিটিকে মোকাবেলা করতে হবে। দেখুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান এলজিবিটির মতো বিষয়কে রাজনৈতিক এজেন্ডা বানিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশে ইউরোপ আমেরিকার সমর্থন না পাওয়ার ভয়ে এলজিবিটি রাজনৈতিক এজেন্ডা হতে পারেনি। এটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিষয়। এরদোগান বলেছেন, ইটস মাই আইডেন্টটিটি। আমাদের মূল্যবোধ। এটির সাথে আপস চলে না। সবার সাথে আমরা কলাবরেট করব। আইডেন্টটিটিকে বিসর্জন দেবো না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও এলজিবিটি নিয়ে আপডেট না। এ জন্য তারা ভয় পায়।

নয়া দিগন্ত : সমাজে তো কোনো অভিভাবকও এলজিবিটি মেনে নিতে পারেন না

ড. হোসেন : অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। কারণ দিনশেষে এলজিবিটির ভিকটিম হলে তাদের সন্তানরাই হবে। এ জন্য তাদের সন্তানদের এ বিষয়ে সাবধান করতে হবে।