পূজায় সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার আশঙ্কা

পূজা চলাকালীন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ৭২% গুজব; নজরদারি বৃদ্ধিসহ ১৪ দফা সুপারিশ গোয়েন্দা সংস্থার

শামছুল ইসলাম
Printed Edition

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব চলাকালে স্বার্থান্বেষী মহল, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ কর্তৃক দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টায় যে কোনো সহিংস ও নাশকতামূলক ঘটনা সঙ্ঘটিত করার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সম্প্রতি সংস্থার এক গোপনীয় প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ১৪টি সুপারিশ করা হয়েছে সেই গোপনীয় প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার অধিকাংশই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যক্তিস্বার্থ ও জনরোষের কারণে সঙ্ঘটিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক কোনো ইস্যু ছিল এমনটি প্রতীয়মান হয়নি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের দুর্গাপূজা উদযাপন উপলক্ষে নিরাপত্তা, সতর্কতা ও নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। নির্বাচন পূর্ববর্তী এ সময় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে নানামুখী অপতৎপরতা চালাতে পারে।

পূজা উদযাপন সংক্রান্ত কমিটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল সংক্রান্ত ঝুঁকি উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি, শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিচালনা কমিটি, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্ট, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন ফ্রন্টসহ বিভিন্ন কমিটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠী কর্তৃক সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাতে পারে। এ ছাড়াও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগসহ স্বার্থান্বেষী মহল দেশকে অস্থিতিশীল ও বহির্বিশে^র কাছে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে আসন্ন দুর্গাপূজায় যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সঙ্ঘটিত করতে পারে।

সাইবার উসকানি ও গুজব ছড়ানোর ঝুঁকি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়িয়ে সরকারবিরোধী কুচক্রীমহল বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়াতে পারে।

সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের ৭২% গুজব : প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০২৪ সালের পূজা চলাকালীন সোস্যাল মিডিয়া পর্যালোচনায় সাতটি ঘটনার মধ্যে দু’টি প্রকৃত ঘটনা ও পাঁচটি গুজব সংক্রান্ত তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক উদঘাটিত হয়েছে। সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যগুলোর মধ্যে ৭২% গুজব বলে প্রতীয়মান হয়। প্রচারিত গুজবগুলো হলো, ঢাকার দোহার উপজেলায় জয়পাড়া মন্দিরে মোহাম্মদ সিদ্দিকী নামে এক ধর্মান্ধ হামলা চালায়। মন্দিরে হামলার পর মাদরাসার উগ্রবাদী ও সব হিন্দুদের হত্যার হুমকি; নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার রায়পুরা পশ্চিম পাড়ায় রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা একটি পূজা মণ্ডপের প্যান্ডেল কেটে লণ্ডভণ্ড করে দেয় যাতে সেখানে পূজা না করতে পারে; সবাই নাকি এবার পাহারা দিচ্ছে। সেনাবাহিনী, জামায়াত-বিএনপির কর্মীরা, মাদরাসার ছাত্ররা। এত পাহারাতেও রাজবাড়ী বাস মালিক সমিতির দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর হলো। ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে প্রশাসন গিয়ে পর্দা টাঙিয়ে ঢেকে দিয়েছে পুরো মন্দির। পাহারার নাটক কি তবে রমনা ও ঢাকেশ^রী মন্দিরের ক্যামেরার সামনেই সীমাবদ্ধ; কিশোরগঞ্জে গভীর রাতে মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর; মূর্তি ভাঙার পর ব্যানার টানিয়ে পূজা। যেদিন ব্যানারও টাঙাতে পারবে না সেদিন কি করবেন সনাতনীরা? গণপাড়া বিশ^াস বাড়ী সার্বজনীন দুর্গামন্দির, কাশিপুর, বরিশাল।

অন্য দিকে সত্য ঘটনা দুটো হলো, তাঁতীবাজার পূজা মণ্ডপে পেট্রোলবোমা বিস্ফোরণ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শক্তিপীঠ যশোরেশ^রী মন্দিরে দুর্গার মুকুট চুরির ঘটনা।

নজরদারী বৃদ্ধিসহ ১৪ দফা সুপারিশ হলো, আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা সঙ্ঘটিত হওয়ার সুযোগ যেন না পায় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা, গোপনীয় নজরদারি বাড়ানো এবং গোপনীয়তার ব্যাপার পুলিশকে অবহিতকরণ নিশ্চিত করা। পূজামণ্ডপে প্রবেশপথে আর্চওয়ে, আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি এবং নারী তল্লাশিকারীর দ্বারা নারী উপাসনাকারী ও দর্শনার্থীদের তল্লাশি কার্যক্রম নিশ্চিতকরণ। বিভিন্ন প্যান্ডেলের নিরাপত্তা সুষ্ঠু করতে স্থানীয় কমিটিগুলোকে উৎসাহিতকরণ এবং সন্দেহজনক ব্যক্তিদের বিষয়ে নজর রাখা। পূজামণ্ডপ সংলগ্ন স্থাপনা ও আশপাশে বসবাসরত ব্যক্তিদের সতর্ক করা এবং সিসি ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে নাশকতামূলক কার্যক্রম প্রতিরোধ। পূজামণ্ডপে অগ্নিকাণ্ড বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। পূজামণ্ডপ সংলগ্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি না হয় সেজন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা। পূজামণ্ডপে অযাচিত ও অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা এড়াতে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা মোতায়েন এবং মণ্ডপ প্রাঙ্গণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল নিশ্চিত করা। দেশের সব পূজামণ্ডপে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সন্ত্রাসী, জঙ্গি কর্তৃক কোনো মন্দির/মণ্ডপে হামলার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। পূজামণ্ডপের ভিতরে ও বাইরে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুবিধাজনক স্থানে পর্যাপ্ত নির্ধারিত গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, টহল দল, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ক্রাইম সিন ভ্যান এবং পুলিশসহ স্ট্যান্ডবাই ফোর্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা। পূজামণ্ডপ এলাকায় সন্দেহজনক ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও ক্রসিং এ চেকপোস্ট স্থাপন করে সন্দেহজনক ব্যক্তি ও যানবাহন তল্লাশি করা। গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলোর স্থির ও ভিডিও চিত্র ধারণের ব্যবস্থা রাখা।