- প্রকল্প ৭০ শতাংশ বাস্তবায়নে ৭ বছর শেষ
- ব্যয় ৪২১ কোটি থেকে এখন ৬০৫ কোটি টাকায়
- সাত বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়-আইএমইডি
গুরুত্বপূর্ণ নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি ধীরগতির। প্রাথমিক ভূমি অধিগ্রহণ ও ভুল পরিকল্পনায় তিন বছরের এই সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি দীর্ঘ ৭ বছরেও শেষ করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। ফলে জনগণের ভোগান্তিসহ প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বেড়েছে লাফিয়ে। এখন খরচ বাড়ছে ১৮৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। তৃতীয় দফায় মেয়াদ আরো ১ বছর বাড়ছে। ছয় বছর ১০ মাসে অর্থাৎ চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৭০ শতাংশ। এ ছাড়াও প্রকল্পের রুট পরিবর্তনে কিছু মানুষের বসতভিটা উচ্ছেদের ঝুঁকিতে পড়েছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে বলে মাঠপর্যায় থেকে জানা গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, সঠিক অ্যালাইনমেন্ট চিহ্নিত না হওয়ায় জমি অধিগ্রহণ, মাটির কাজ, কালভার্ট নির্মাণ এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সাথে নবীনগরের সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। ফলে বর্তমানে নবীনগর একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। নবীনগর উপজেলা থেকে জেলা শহরে যেতে হলে পাশের জেলা কুমিল্লার কোম্পানীগঞ্জ, মুরাদনগর উপজেলা হয়ে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার ঘুরে কিংবা রাজধানী ঢাকা যেতে হলে বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন আঁকাবাঁকা ৫৪ কিলোমিটার সড়ক হয়ে নারায়ণগঞ্জের ভুলতা ধনবাড়িয়া হয়ে ঢাকায় যেতে হয়। নবীনগরের মানুষদের দুর্ভোগ লাঘবে এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নবীনগর-আশুগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন হয়। ১৯ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ দশমিক ৩ ফুট প্রস্তের সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ জুলাই। ২০২১ সালের জুন মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনুমোদিত প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ না থাকা, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা, প্রকল্প প্রণয়ন কমিটির বিশেষজ্ঞদের ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণে ভুল, ঠিকাদারের সময়মতো কাজ শুরু করতে না পারা ও প্রকল্প সংশোধনের কারণে কাজ শুরু করা যায়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের তথ্য বলছে, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প (জেড-২০৩১) (১ম সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে ৩য় বার মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছাড়াও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, আইএমইডিসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার সাথে ঢাকা-সিলেট জাতীয় মহাসড়ক (এন-২) এর সংযোগ ঘটানোর মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং প্রকল্প এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প (জেড-২০৩১) শীর্ষক প্রকল্পটি মোট ৪২১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০১৮ হতে জুন ২০২১ মেয়াদে ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট একনেক অনুমোদন করে। পরে পরিকল্পনা কমিশন ২০২১ সালের ৪ মে প্রকল্পটির ১ম বার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত ২ (দুই) বছর বৃদ্ধি করা হয়। প্রকল্পটির কতিপয় অঙ্গ হাস বা বৃদ্ধি করে ১ম সংশোধিত ডিপিপি মোট ৬০৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৩০ জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নে ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর একনেক অনুমোদন দেয়। এরপর পরিকল্পনা কমিশন ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর আবার প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত আরো দুই বছর বৃদ্ধি করে। বর্তমানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক প্রকল্পটির ৩য় বার ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ ১ জুলাই ২০১৮ হতে ৩০ জুন ২০২৭ পর্যন্ত আরো দুই বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। তবে আইএমইডি চলতি বছরের আগস্টে মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর সুপারিশ দিয়েছে।
প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৭০ শতাংশ
এ দিকে প্রকল্পটি এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত ৬ বছর ১০ মাসে আর্থিক অগ্রগতি ৬০.৮০ শতাংশ এবং বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৭২ শতাংশ। চলতি ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পটির অনুকূলে ১৪৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ
স্থানীয় জনসাধারণ বলছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তির স্বার্থে এবং অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নকশা পরিবর্তন করে বসতবাড়ির ওপর দিয়ে সড়ক নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রুট পরিবর্তন ও উচ্ছেদে চর লালপুর নোয়াগাঁও অংশে সড়ক রুট পরিবর্তনের কারণে অন্তত ৪০টি পরিবারের বসতভিটা উচ্ছেদের ঝুঁকিতে পড়েছে।
আইএমইডি যা বলছে
আর প্রকল্পটির ব্যাপারে আইএমইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বক্তব্য হলো, সাত বছর ধরে চলমান প্রকল্পটির অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। প্রকল্পের মূল বাস্তবায়ন মেয়াদকাল ২০১৮ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ১ম বার দুই বছর এবং পরবর্তীতে আরো দুই বছরসহ মোট চার বছর ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ বৃদ্ধি পায়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক ডিপিপির প্রশাসনিক আদেশ জারির এক বছর পর ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক আদেশ দেয় হয়। এরও এক বছরের অধিক সময় পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব প্রেরণে অত্যধিক বিলম্বের কারণে প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়েছে। এ পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করা হলে প্রাপ্ত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে মর্মে প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে প্রত্যয়ন গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যতে আর সময় বৃদ্ধি করা হবে না।
মন্ত্রণালয় যা বলছে
ভুল পরিকল্পনার ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলেন, মূল ডিপিপি তৈরিতে তৃতীয় পক্ষের (সার্ভে কনসালটেন্ট) মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করে ভূমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া অনুমোদিত ডিপিপিতে জমির মূল্য নির্ধারণে শুধু নাল শ্রেণী উল্লেখ করায় ক্ষতিপূরণ যথাযথভাবে নির্ধারণেও ত্রুটি রয়ে যায়। তারা বলেন, পরিবর্তিতে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে ত্রুটিগুলো সামনে আসায় প্রকল্পটি সংশোধনের প্রয়োজন হয়। সংশ্লিষ্ট কনসালটেন্ট এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এরপর সড়কের ডিজাইন ও রিডিউসড লেভেল অনুযায়ী ১ম সংশোধিত ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়, যা গত ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ কাজ আরম্ভ করতে বিলম্ব হওয়ার ফলে পূর্ত কাজেও বিলম্ব হয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধির প্রয়োজন।
যা জানালেন প্রকল্প পরিচালক
প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক জানান, প্রকল্পটি ২০১৮ সালে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হলেও অনুমোদিত প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ও ব্যয় প্রাক্কলন নির্ধারণে ত্রুটি থাকায় তা ২০২২ সালে সংশোধন করা হয়। মূলত সংশোধনের পর থেকেই প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়। বর্তমানে ৭টি এল এ কেসের মধ্যে ২টি এল এ কেস ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৫টি এল এ কেসের যৌথ তদন্ত কার্যক্রম পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছে। ইউটিলিটি শিফটিং এখনো সম্পন্ন হয়নি। প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৭টি প্যাকেজের মধ্যে ডচ-০৩ এবং ডচ-০৪ প্যাকেজের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ৫টি প্যাকেজের কাজ যথাক্রমে ৫০ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ৮৪ শতাংশ, ৩০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ডচ-০৭ প্যাকেজের কাজ এখনো আরম্ভ হয়নি। ফলে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্যাকেজগুলোর পূর্তকাজ সমাপ্ত করার জন্য আরও দুই বছর সময়ের প্রয়োজন।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, বর্ধিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হলে প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম দ্রুত সমাপ্তির জন্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা/দফতরের সাথে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।