পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ আট বছর ব্যাংকিং খাতের ওপর ঝড় বয়ে গিয়েছিল। এ সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্গীদের সরাসরি হস্তক্ষেপে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয়। জনগণের আমানতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চপর্যায় থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার কারও সাথে বর্গীদের ভাগবাটোয়ারার আসর বসত। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হতো না। যার যখন ইচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয়া হতো। আর এর ফলে এক সময়ে দেশের শীর্ষ সবল ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের নির্লিপ্ততা ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংকগুলোর তদারকির কার্যক্রম ভেঙে পড়েছিল। কিছু ব্যাংকের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রম। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আড়াল করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতেই সায় দিতো। বাস্তবে ভেতরে ফাঁপা হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর সংবেদনশীল তথ্যগুলো ভালো মানের বলে দেখাতে হতো।
ইসলামী ব্যাংকগুলো ছিল একসময় দেশের সেরা ব্যাংক। আমানত প্রবাহ, বিনিয়োগ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্স সংগ্রহে নিচের দিক থেকে ডজন খানেক ব্যাংকের চেয়ে বেশি অংশীদার ছিল ব্যাংকটি। কিন্তু ২০১৭ সালে রাতের অন্ধকারে ব্যাংকটি দখল করে নেয় বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম। তার পেছনে ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র। আর এ কারণে এক সময়ের সাধারণ মানের ব্যবসায়ী এস আলম হয়ে উঠে ব্যাংক খাতের মাফিয়া। পতিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও তার পরিবারের সাথে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এ সুবাদে একে একে দেশের আটটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের মালিকানা তার হাতে তুলে দেয়া হয়। মালিকানা পেয়েই তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ব্যাংকের পরীক্ষিত কর্মকর্তাকে রাতারাতি চাকরি চ্যুত করেন। পানির মতো টাকা বের করে নিতে বাধা এমন কর্মকর্তাদের নির্বিচারে চাকরিচ্যুত করেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানি করা হতো। তার পিএস আকিজ উদ্দিন ও মিফতা উদ্দিন একপর্যায়ে তার টাকা বের করে দেয়ার প্রধান সিপাহসালারের ভূমিকায় নামেন। সাথে কোম্পানি সেক্রেটারি জেকিউ হাবিবুল্লাহ গংরাও ছিল সক্রিয়। আর এদের মাধ্যমেই ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক,
এক্সিম ব্যাংকও এক সময় ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এক্সিম ব্যাংকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। ভিন্নমতের পরিচালকদের কোনো পাত্তা দেয়া হতো না। মজুমদার যা বলতেন তার ওপর আর কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না। আর এ কারণেই ব্যাংকটি থেকে নামে বেনামে অর্থ বের করে নেয়ায় দুর্বল ব্যাংকের কাতারে নাম লেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন প্রায় ৫০ শতাংশ। ব্যাংক এশিয়ার কাছ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দেয়ায় আদালত থেকে এক্সিম ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৫ ইসলামী ব্যাংক একীভূত করার যে তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে এক্সিম ব্যাংকও রয়েছে।
এক্সিম ব্যাংকের মতো আইএফআইসি ব্যাংক থেকেও অর্থ হাতিয়ে নেয় পতিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি রাষ্ট্রখাতের জনতা ব্যাংক থেকেও বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এভাবে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে শিকদার গ্রুপ, প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে এইচবিএম ইকবালসহ এক ধরনের সরকার সমর্থিত পরিচালকরাই পুরো ব্যাংকের মালিক বনে গিয়েছিলেন।
তবে জনগণের আমানত হাতিয়ে নেয়ার এসব দৃশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। জনগণের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। আর এর অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের কারণে। বিশেষ করে ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক যোগ্য কর্মকর্তাও ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ মাফিয়াদের কাছে ধরনা দিতেন। তাদের সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই ডেপুটি গভর্নর হতেন। পাশাপাশি এসব মাফিয়াদের সুবিধাভোগী বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কিছু কর্মকর্তা ছিলেন। বিভিন্ন সেক্টর থেকে দুর্নীতিবাজদের বিদায় করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন কাউকে বিদায় করার পরিবর্তে পদোন্নতির মাধ্যমে পুরস্কৃত করারও অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘাপটি মারা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনিয়ম দূর করতে এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।