পাহাড়ে অস্থিরতা বাড়াতে ভারত ইউপিডিএফকে অস্ত্র দিচ্ছে

সাক্ষাৎকার : রাওয়া চেয়ারম্যান কর্ণেল হক

মোস্তাফিজুর রহমান
এস এম মিন্টু
Printed Edition
রাওয়া চেয়ারম্যান কর্ণেল হক
রাওয়া চেয়ারম্যান কর্ণেল হক |নয়া দিগন্ত

সম্প্রতি একটি কথিত ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও এর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। উত্তেজনার মধ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে তিনজন নিহত এবং সেনাবাহিনীর ১৩ সদস্যসহ অর্ধশত আহত এবং বহু বাড়িঘরে আগুন দিয়ে পুরো পাহারকে অশান্ত করে তুলে। এসব বিষয় নিয়ে গতকাল সকালে নয়া দিগন্তকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব:) মোহাম্মদ আবদুল হক। সাক্ষাৎকারটি নেন নয়া দিগন্তের সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান ও এস এম মিন্টু।

নয়া দিগন্ত : খাগড়াছড়িতে হঠাৎ অস্থিরতার কারণ কি?

আবদুল হক : খাগড়াছড়িতে কথিত ধর্ষণের অভিযোগ তুলে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আহত করার ঘটনায় নেপথ্যে ভারতের ইন্ধন রয়েছে। ইউপিডিএফ পাহাড়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, জোরপূর্বক বাড়ি-ঘর দখল ও হত্যাসহ অপহরণের সাথে সরাসরি জড়িত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ জড়িত। দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখতে হলে ইউপিডিএফকে পাহাড় থেকে সরাতে হবে। তাদের সাথে ভারতের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। সেখানে তাদের ক্যাম্পও আছে। ভারত থেকে অস্ত্র এনে পার্বত্যাঞ্চল তথা চট্টগ্রাম বিভাগকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইউপিডিএফের সশস্ত্র সংগঠনগুলো।

নয়া দিগন্ত : তা হলে আপনি বলতে চাচ্ছেন ভারতই মূল ষড়যন্ত্রকারী ? এসবের পেছনে কারণই বা কি?

আবদুল হক : একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে এবং সেখানে চাকরি করার সুবাদে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই দেশের অখণ্ডতাকে বিচ্ছিন্ন করে, এই দেশটাকে চিরতরে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের কব্জায় নেয়ার জন্য পাহাড়ে অস্থিরতার মতো ঘটনাগুলো ঘটায়। পাহাড় তো আমাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১/১০ শতাংশ ভূমি আমাদের। তিনটা পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। পৃথিবীতে অনেক সুন্দর জায়গার চেয়েও আমাদের এই পার্বত্য চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে যেমন সমভূমি, পাহাড়, পর্বত, রাস্তাঘাট, ঝর্ণা আকাশছোঁয়া উচ্চতা, মেঘের ভিতর দিয়ে সে দৃশ্যগুলো দেখার জন্য সেখানে পর্যটকরা আসে। ভারত চায়না আমরা শান্তিতে থাকি। আমাদের দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক। এ জন্যই তারা চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলকে টার্গেট করেছে।

নয়া দিগন্ত : পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ইউপিডিএফ বা ভারতের মাথা ব্যথা কেন?

আবদুল হক : আমাদের বাংলাদেশের জন্মটাই হয়েছে একটা অটিস্টিক শিশুর মতো। তা না হলে পৃথিবীর কোনো দেশের মানচিত্র কি এরকম আঁকাবাঁকা, ভিতরে ত্যাড়াব্যাকা দেখেছেন কোথাও আছে? নাই। সীমান্তের বাড়িগুলো এমন- আপনার গোয়ালঘর পড়ছে ভারতে আর রান্নাঘর পড়ছে বাংলাদেশে। এগুলো সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দুত্ববাদীরা করেছে। অসুস্থ অথবা দুর্বল টার্গেটের দৌড়ানোর প্রয়োজন হয় না। এক লাফেই খেয়ে ফেলতে পারে। এই দেশটাকে চিরতরে গিলে খাওয়ার একটা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা এই আঁকাবাঁকা ম্যাপ দিয়ে আমাদেরকে খেয়ে ফেলতে পারে। দেশটাকে খাবে কিভাবে? এক সাথে তো সব খাওয়া যাবে না পুরো বাড়িটা। তারা প্রথম ধরতে চায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে। গত এক সপ্তাহ আগে ত্রিপুরার রাজা অধ্যত্ব রাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করেছেন যে, আমরা এই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবিলম্বে দখল করব এবং এটাকে ইন্ডিয়া, মানে একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এর পর চট্টগ্রামকে দখল করবে এবং আমাদের পোর্টকে তারা দখল করবে। বাংলাদেশের এই তিনটা পার্বত্য জেলাকে দখল করার একটা অংশ হিসাবে এই কাজগুলো গোপনে ভারত করছে। শুধু তিনটা পার্বত্য না, এর সাথে চট্টগ্রাম, ফেনী রয়েছে। ফেনী নদীর এপাশে তো মূল ভূখণ্ড আমাদের, মাত্র একটা নদী এবং চিকন একটা জায়গা, এই যেটা ইকোনমিক জোন করেছে মীরসরাইতে। মীরসরাইতে আপনার বিশাল একটা জায়গা আদানি গ্রুপকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার ওইখানে যাতায়াতের জন্য রাস্তা করে দেয়া হয়েছে। এগুলো কিসের অংশ? আর আওয়ামী লীগ নামক দলটি তৈরি করা হয়েছে, যাতে দেশটাকে দখল করে নিতে পারে ভারত। সেইটাই মূল ফাঁক।

নয়া দিগন্ত : যে মেয়েটিকে ধর্ষণের কথা বলা হচ্ছে মেডিক্যাল তো বলছে সব অসত্য

আবদুল হক : একটা মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হলেও বাস্তব হলো, ধর্ষণই হয় নাই। মেডিক্যাল রিপোর্টও তাই বলছে, সে ধর্ষণের শিকার হয়নি। ১২ বছরের একটা মেয়ে, তার সাথে প্রেম প্রীতি আছে আরেকজনের। সেটাকে কত গভীরে সাজিয়ে তারা এটাকে একটা আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে। এটার সাথে সরাসরি আমাদের দেশের সেই আউটস্টেক পলিটিক্যাল পার্টি, আওয়ামী লীগ এবং তার দোসররা। দোসররা সেখানে, আপনারা এই যে ইউপিডিএফ-এর কথা বললেন, তারাও তো এখন সশস্ত্র। শুধু তাই না, বাইরে থেকে ওখানে লোক গিয়ে এটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলে ধরছে। ইউপিডিএফ যে অস্ত্র পাচ্ছে, এটা কোত্থেকে আসছে আসলে? সরাসরি যদি বলি, ভারত থেকে আসে। কোনো ভুল নেই। ত্রিপুরাতে ইউপিডিএফের ক্যাম্প আছে। সেখানে তারা ট্রেনিংয়ের মধ্যে আছে। দেখুন, মূল পাহাড়ের যারা বসবাসকারী তারা তো খুব ভালো লোক ছিলেন। আমি সেখানে চাকরি করেছি। আমি যেকোনো জায়গায় গেছি, আমার সময়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটাতে দেইনি আমি। আমি ভালোবাসা দিয়ে পাহাড়ি এবং বাংলাদেশের সবাইকে বলতাম যে, আপনারা কেউ পাহাড়ি না, কেউ বাঙালি না, সবাই বাংলাদেশী। আপনাদের পরিচয় হলো, আপনারা বাংলাদেশী। এই যে বিশ্বাস, এটাকে ভালোবাসা দিয়ে আমরা জয় করতে পারি নাই। কেন পারি নাই? ভারতের ইন্ধনে। ভারতের ইন্ধনে এবং নানাবিধ স্বার্থ আছে এখানে। চাঁদাবাজি হয়। ইউপিডিএফ-এর অন্যতম কাজ হলো চাঁদাবাজি করা। কোটি কোটি টাকা তারা অর্জন করছে চাঁদাবাজি করে। প্রত্যেকটা লোক মাছ ধরার জেলে, চাষাবাদ, এমনকি একটা কলা বিক্রেতার কাছ থেকেও তারা চাঁদাবাজি করছে। এটা একটা তাদের নেশায় পরিণত হয়ে গেছে। মেয়েটির একটি সাধারণ ঘরেই জন্ম। আজ সামাজিকভাবে তাকে কতটা হেয় করলো। তার কথা চিন্তা হলে আমার লজ্জা হয়। কেন এই মিথ্যা ব্লেইম দিয়ে সমাজে খাটো করা হলো। শুধুই চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে মিথ্যা তথ্যকে নিকৃষ্টভাবে বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।

নয়া দিগন্ত : পার্বত্যাঞ্চল রক্ষায় এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী?

আবদুল হক : আমি প্রায়ই এই প্রশ্নটা অনেককে করি যে, এই পার্বত্য জেলার তিনটার মালিক কে? সাধারণত আপনি বলবেন, বাংলাদেশ। কিন্তু আমি বলি না। আপনারা তা বিশ্বাস করেন না। আপনারা মনে করেন এটা আর্মির (সেনাবাহিনী)। আর্মি ছাড়া এটার জন্য আর কেউ দায়ী নয়, রেস্পন্সিবল নয়। এটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আর্মির, পালন করার দায়িত্ব আর্মির, মারামারি করারও দায়িত্ব আর্মির, মানুষকে প্রতিহত করার দায়িত্ব আর্মির। কেন? কেন হবে? এটাতে তো সরকার কর্তৃকভাবে যুক্ত হতে হবে না। বাংলাদেশ সরকার, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরিভাবে এটার সাথে ইনভলভ হতে পারে নাই বলেই আর্মির অ্যাসেট হয়ে গেছে এটা। এখানে চিন্তা করতে হবে। এখানে মনে হয় যেন সেনাবাহিনীর চেয়ে সরকারের ভূমিকাটা বেশি হওয়া উচিত। অবশ্যই। এখানে সিভিল প্রশাসনের ভূমিকা কী? কয়জন সেক্রেটারি আর্টিকেল লেখছে? পার্বত্য চট্টগ্রামের উপরে গবেষণা করে? লিখেছেন? কয়জন ডিসি গভীরে গেছে। যখন অস্থিরতা শুরু হলো সেখানে ডিসিরা ছিলেন। কয়জন ডিসি প্রথমত তাৎক্ষণিক যেতে পেরেছেন? যান নাই তারা। এই সমস্যার সমাধান সেনাবাহিনী না, এটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিত। কোনো দেশে শুধু আর্মি দিয়ে কোনো সমাধান হয় না। গভর্নমেন্টকে দায়িত্ব নিতে হবে, প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে। আপনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদ নামে একটা শক্তিশালী সংগঠন আছে, সেখানকার চেয়ারম্যান হলেন মেজর জেনারেল (অব:) অনুপ কুমার চাকমা। উনি কি ওইখানে (খাগড়াছড়ি) এই ঘটনার পরে কি একবারও গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন? উনার জাতিগোষ্ঠীকে কি থামিয়েছেন? ‘এই তোমরা কী করতেছো?’ আমি তো জানি, কিছুই হয় নাই। এটা কি করেছেন উনি? করেন নাই। এগুলো তো অনেক কিছু। পার্বত্যাঞ্চলে বিভাগীয় কমিশনার আছেন। তিনটি ডিস্ট্রিক্টের তিনজন ডিসি আছেন, তারা কি এক সাথে বসে একটা মিটিং করেছে? মিটিং করে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন? ওইখানের প্রথম, আজকে আমরা যাদেরকে বাঙালি বলি, সেখানে গিয়ে দেখেন তাদের খাবার নাই, তাদের এডুকেশন নাই, তাদের গায়ে বস্ত্র নাই, তাদের চিকিৎসা নাই। সকল বেসিক রাইটস থেকে তারা বঞ্চিত। এনজিওরা তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। আর হাজার হাজার এনজিও গড়ে উঠেছে। বিদেশী এনজিওগুলো তো একটা ব্যবসা। তারা এই চাকমা কিংবা উপজাতিদেরকে খ্রিষ্টান বানানোর প্রচেষ্টায়, খ্রিষ্টান রাজত্ব কায়েম করার কাজে ব্যস্ত। অনবরত কাজ চালাচ্ছে। এনজিওগুলোর মেইন টার্গেট হলো এই উপজাতিরা। আপনারা দেখেছেন খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার হাসান খুব সুন্দরভাবে সিচুয়েশন ট্যাকেল করেছে। মনে হয়েছে এটা তারই সম্পত্তি, তাকে ছাড়া আর কারো দায়িত্ব নেই। আজকে সেনাবাহিনী এত কিছু করছে, কেউ অ্যাপ্রিশিয়েট করে না। ৪০০ লোক শহীদ হয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্য, অফিসার, জেসিও, সৈনিক। কেউ খবর রাখে? তাদের ফ্যামিলির খবর রাখে? হ্যাঁ, যারা দেশ রক্ষা করতেছে। আপনি তো এই আন্দোলনে আহত-নিহতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য করছেন। এই ৪০০ সৈনিকের তাদের পরিবার হয়তো শেষই হয়ে গেছে। ৪০০ সদস্যের। এই দেশ কি খবর রেখেছে? ইন্ডিয়াতে দেখেন কিভাবে তারা সম্মানিত করে, তারা কতটুকু উপরে রাখে তাদের সেনাবাহিনীকে। আমরা কি পেরেছি সেটা? খালি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদগার।

নয়া দিগন্ত : আপনাকে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ।

আবদুল হক : নয়া দিগন্তের সকলকে ধন্যবাদ।