নগরায়ন ও আবাসন খাতের দ্রুত পরিবর্তিত চাহিদা পূরণে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ায় ভূমি ব্যবস্থাপনা, অধিগ্রহণ, বরাদ্দ ও আর্থিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের পঞ্চম অধ্যায়ে রাজউককে আরো বেশি ক্রয়, ইজারা, অধিগ্রহণ ও তহবিল ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এই অধ্যায় রাজউকের ভূমি-অর্থনীতিকে এক ধরনের ‘আধা-স্বায়ত্তশাসিত করপোরেট মডেল’-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ভূমি ক্রয় ও ইজারায় অধিক ক্ষমতা : ধারা ৫৫-এ বলা হয়েছে, আইনটির উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রাজউক যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ভূমি ক্রয়, ইজারা বা বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জন করতে পারবে। পূর্বের আইনে রাজউকের নিজস্ব ক্রয়ক্ষমতা সীমিত ছিল; জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সেটি করতে হতো। প্রস্তাবিত আইনে সরাসরি ক্রয়ক্ষমতা যোগ হওয়ায় রাজউকের গতিশীলতা বাড়বে, কিন্তু স্বচ্ছতা ও বাজারদরের প্রশ্ন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ও ২০১৭ সালের আইন : ধারা ৫০ অনুযায়ী, রাজউকের প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণ ‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭’-এর আওতায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক করা হবে। এখানে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা বজায় রাখা হয়েছে, তবে পুরনো আইনের ৮০-৯৩ ধারার অনেক অংশ বাতিল করে নতুন প্রক্রিয়াকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিগ্রহণে একাধিক আইনের সমন্বয় না হলে মামলা-সংক্রান্ত জটিলতা থেকেই যাবে।
উৎকর্ষ সাধন ফি- বাড়তি মূল্যে অংশীদারিত্ব : ৫৭-৫৮-ধারাতে ‘উৎকর্ষ সাধন ফি’ এর বিধান নতুনভাবে যোগ করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে কোনো এলাকার ভূমির মূল্য বৃদ্ধি পেলে, মালিক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে ফি আদায় করতে পারবে রাজউক। এটি আন্তর্জাতিক শহর পরিকল্পনায় ‘বেটারমেন্ট লেভি’ বা ‘ল্যান্ড ভ্যালু ক্যাপচার’-এর মতো একটি পদ্ধতি। নগর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে রাজউকের আয়ের নতুন উৎস তৈরি হবে, তবে ফি-হার ও মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি স্বচ্ছ না হলে মালিকদের সাথে বিরোধ বাড়বে।
ভূমি বরাদ্দে অগ্রাধিকার ও লটারি পদ্ধতি : ধারা ৬০-এ স্পষ্ট করা হয়েছে, অধিগ্রহণকৃত এলাকার মূল অধিবাসী, তাদের উত্তরাধিকারী ও দরিদ্র-ভূমিহীনদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটি পূর্বের আইনে স্পষ্ট ছিল না। নতুনভাবে লটারি ও ন্যূনতম মূল্যধার্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘ইতিবাচক সামাজিক সুরক্ষা ধারা’ বলে দেখছেন, তবে লটারির স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা রাজউকের বড় দায়িত্ব হবে।
আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নমনীয়তা : ধারা ৬১-৬৭-তে রাজউককে সরকারি অনুমোদনক্রমে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ, ঋণপত্র ইস্যু, বিনিয়োগ, মূলধনী ও রাজস্ব তহবিল পৃথকীকরণ এবং দুই তহবিলের মধ্যে স্থানান্তর করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আগের আইনে এসব ধারা ছড়ানো ছিল; এবার একত্রে সাজানো হয়েছে। ধারা ৬৫-তে মূলধনী ও রাজস্ব তহবিলের উৎস, ব্যয় ও জমা রাখার ব্যাংক স্পষ্ট করা হয়েছে। ধারা ৬৬-তে রাজস্ব থেকে মূলধনী তহবিলে অর্থ স্থানান্তরের নিয়ম যোগ হয়েছে। ধারা ৬৭-তে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দ্বারা বার্ষিক নিরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিধানগুলো রাজউককে প্রকল্পভিত্তিক অর্থায়ন, সঞ্চয়পত্র বা ডিবেঞ্চারের মাধ্যমে নগর উন্নয়নের অর্থ সংগ্রহের সুযোগ দেবে। তবে এতে ঋণঝুঁকি ও দায়মুক্তির নিশ্চয়তা স্পষ্ট না হলে আর্থিক অনিয়মের সম্ভাবনাও বাড়তে পারে।
স্থানীয় সরকার ও অংশীদারিত্ব : ধারা ১৪-এ স্থানীয় সরকারকে রাজউকের উন্নয়ন তহবিলে প্রতি বছর ভূমির বার্ষিক মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে অর্থ প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি রাজস্ব-শেয়ারিং মডেল তৈরি করবে। তবে স্থানীয় সরকার যদি সময়মতো অর্থ না দেয়, তাহলে উন্নয়নকার্যক্রমে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
যৌক্তিকতা ও প্রেক্ষাপট : প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে দেখা যাচ্ছে, পুরনো ধারাগুলোর অনেক অংশ (৮০-৯৩, ১০৪-১১৬) বাতিল বা সমন্বিত করা হয়েছে। ‘লটারি’, ‘উৎকর্ষ সাধন ফি’, ‘অগ্রাধিকার বরাদ্দ’ ও ‘তহবিল স্থানান্তর’-সবগুলো নতুন সংযোজন। অর্থ ও তহবিল সংক্রান্ত বিধান সময়োপযোগী করে ধারা ৬৫ পুনর্লিখন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের কমিটি প্রতিবেদন অনুযায়ী সংশোধন যুক্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন রাজউকের এই নতুন আইনি ক্ষমতা নগর উন্নয়নকে দ্রুততর করতে পারে কিন্তু স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সামাজিক ভারসাম্য নিশ্চিত না করলে ভূমি-বাজারে চাপ, মামলাজট, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সুবিধা নেয়া এবং আর্থিক দায়বদ্ধতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই আইনের অধীন স্পষ্ট নীতিমালা, অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া ও শক্তিশালী নিরীক্ষা ব্যবস্থাই হবে কার্যকারিতার মূল চাবিকাঠি।
‘রাজউক অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর পঞ্চম অধ্যায় রাজউককে একদিকে যেমন আধুনিক নগর অর্থনীতির টুল (উৎকর্ষ সাধন ফি, তহবিল স্থানান্তর) দিচ্ছে, তেমনি ভূমি বরাদ্দে সামাজিক দায়বদ্ধতার ধারা যোগ করছে। কিন্তু সফল বাস্তবায়নের জন্য রাজউককে অধিগ্রহণ, ফি-হার, লটারি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে-নচেৎ এ শক্তি নিজেই নতুন সঙ্কটের জন্ম দিতে পারে।