নারীর অদেখা শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে জিডিপিতে

সার্বিক অবৈতনিক শ্রমের মূল্য জিডিপির ১৪.০৩ থেকে ২১.৮৮ শতাংশ

এই কাজগুলো মূলত নারীরাই করেন কিন্তু এগুলোর কোনো মজুরি নেই, জাতীয় আয়ে হিসাবও থাকে না। এখন থেকে সেই অদেখা শ্রমের মূল্য জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিদিনই নারী-পুরুষের অদৃশ্য ও দৃশ্যমান শ্রমে চলছে। এর বড় অংশই থেকে যায় ঘরোয়া রান্না, শিশু ও বৃদ্ধের যত্ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা-যা অর্থনীতিতে ‘গৃহকর্ম’ নামে পরিচিত। এই কাজগুলো মূলত নারীরাই করেন কিন্তু এগুলোর কোনো মজুরি নেই, জাতীয় আয়ে হিসাবও থাকে না। এখন থেকে সেই অদেখা শ্রমের মূল্য জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বাংলাদেশ সরকার এক যুগান্তকারী নীতিগত ঘোষণা দিয়েছে যে নারীর অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যতœ কাজের অর্থনৈতিক মূল্য জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর অংশ হিসেবে চালু হয়েছে হাউসহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট (এইচপিএসএ) যা দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রণী উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

অবৈতনিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্য

এই সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়। ব্যুরো ২০২১ সালে এ নিয়ে টাইম ইউজ সার্ভে (টিইউএস) চালায়। জরিপে দেখা যায়, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নারীরা পুরুষদের তুলনায় গড়ে সাত গুণ বেশি সময় অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যতœকাজে ব্যয় করেন। প্রতিবেদন অনুসারে- নারীরা প্রতিদিন ৫.৯ ঘণ্টা গৃহস্থালি ও যতœকাজে আর মাত্র ১.২ ঘণ্টা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সময় দেন। এর বিপরীতে পুরুষরা অবৈতনিক কাজে অংশ নেন খুব সীমিতভাবে।

বার্ষিক হিসাবে নারীরা এক হাজার ২০৮ ঘণ্টা রান্না, ৪১৮ ঘণ্টা শিশুযতœ, ২৩৭ ঘণ্টা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ব্যয় করে। পুরুষরা ৬৩ ঘণ্টা বাজার করা, ৫৭ ঘণ্টা শিশুযতœ, ৪৪ ঘণ্টা পরিবারের পরিবহন কাজে ব্যয় করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বৈষম্য মূলত সামাজিক রীতিনীতি ও লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবণ্টনের ফল।

এইচপিএসএ : পদ্ধতি ও ফলাফল

এইচপিএসএ ২০২১ সালের টিইউএস ও ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের (এলএফএস) তথ্য ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশনের (ইউএনইসিই) নির্দেশনা মেনে এটি ইনপুট পদ্ধতিতে (শ্রমমূল্য) মূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে মূল্য নির্ধারণে ব্যবহার করা হয়েছে হাইব্রিড রিপ্লেসমেন্ট কস্ট পদ্ধতি-যাতে বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ উভয় ধরনের মজুরি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

এর ফলাফল হলো : নারীর অবৈতনিক কাজের মূল্য জিডিপির ১২.০৪ শতাংশ থেকে ১৮.৬৫ শতাংশ। পুরুষদের অবৈতনিক কাজ মাত্র ২.০০ শতাংশ থেকে ৩.২৪ শতাংশ। আর সামগ্রিক অবৈতনিক কাজের মূল্য জিডিপির ১৪.০৩ শতাংশ থেকে ২১.৮৮ শতাংশ।

মূলত নারীরাই অবৈতনিক শ্রমের ভার বহন করেন- যা টাকায় দাঁড়ায় ৪.৩ থেকে ৬.৬ ট্রিলিয়ন টাকা, যেখানে পুরুষদের অবদান মাত্র ৭০৫ বিলিয়ন থেকে ১.১ ট্রিলিয়ন টাকা (২০২১ সালের হিসাবে)।

সীমাবদ্ধতা ও সতর্কতা

টিইউএস কোভিড-১৯ সময়কালে হওয়ায় কিছু তথ্যপ্রবাহে ভিন্নতা থাকতে পারে। এলএফএসের মজুরি তথ্যও সীমিত ছিল। ফলে অনুমানে কিছু বিচ্যুতি থাকতে পারে। তবে এইচপিএসএ ভবিষ্যতে আরো হালনাগাদ তথ্য যোগ করে শক্তিশালী হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কেন গুরুত্বপূর্ণ

অবৈতনিক যতœকাজ নারীর সময়, আয়ের সুযোগ, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা সীমিত করে। ফলে নারীরা দীর্ঘসময় ধরে পেশাগত সুযোগ হারান, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ কমে যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাও সীমিত থাকে।

বাংলাদেশের এইচপিএসএ শুধু হিসাবের খাতা নয়- এটি নারীর অবদানকে নীতিনির্ধারণ, বাজেট প্রণয়ন ও প্রোগ্রাম পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তির কৌশলগত হাতিয়ার।

করণীয়: ‘৫ আর’ ফ্রেমওয়ার্ক

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিস্টেমিক পরিবর্তনের জন্য দরকার জাতীয় সমন্বয় কাঠামো। ৫ আর-রেকগনাইজ, রিডিউস, রিডিস্ট্রিবিউট, রিওয়ার্ড, রিপ্রেজেন্ট-এই নীতিমালা অনুসারে : ঘরোয়া কাজকে স্বীকৃতি দেয়া; কাজের বোঝা কমানো ও পুনর্বণ্টন; যথাযথ মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং শ্রমবাজারে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন।

একই সাথে অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতি, সরকারি বাজেট, বেসরকারি খাতের পারিবারিক-বান্ধব নীতি, মানসম্পন্ন যতœ-সুবিধা বিনিয়োগ এবং বেতন বৈষম্য কমানোর আইন সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্ন কাজকে জিডিপির অংশ হিসেবে ধরা বাংলাদেশের নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে এক বড় পদক্ষেপ। এটি শুধু সংখ্যা নয়, বরং অদৃশ্য শ্রমকে দৃশ্যমান করে নীতি, বাজেট ও সামাজিক মনোভাব পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি করছে।

নিয়মিত তথ্যসংগ্রহ, বাজেট বরাদ্দ ও সামাজিক আচরণগত পরিবর্তন যদি বাস্তবায়ন হয়, তবে এটি ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের কৌশল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।