পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনÑ বিটিআরসিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও দলীয়করণ করা হয়েছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে গঠিত কয়েকটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ইতোমধ্যে ২৯ কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জনের নিয়োগ-পদোন্নতিতে তিনটি কমিটি অনিয়ম পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে ২৯ জন জুনিয়র পরামর্শককে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে ডাক, টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান, তথ্য এবং প্রযুক্তি অডিট অধিদফতরের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি ও অডিট অধিদফতরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
২৯ জন জুনিয়র পরামর্শক নিয়োগে বিধিলঙ্ঘন : ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিটিআরসির অফিসে ২৯ জুনিয়র পরামর্শককে রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ডাক, টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান, তথ্য এবং প্রযুক্তি অডিট অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্ত ২৯ জুনিয়র পরামর্শকের রাজস্ব খাতভুক্ত হওয়ার প্রমাণক, বহুল প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, লিখিত পরীক্ষা আয়োজন করার প্রমাণক, অর্গানোগ্রাম সংক্রান্ত কমিশনের অনুমোদনের কপি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামতের কপি না থাকায় এ-সংক্রান্ত যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক প্রমাণকসহ পুনঃজবাব দেয়ার জন্য বিটিআরসিকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
১৭ ড্রাইভার নিয়োগের বিধি লঙ্ঘন : বিটিআরসিতে ১৭ ড্রাইভার নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০০৯ ও ২০১০ সালে দু’টি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে একটিতে সর্বোচ্চ বয়স ৩০ ও অন্যটিতে সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ উল্লেখ করা হয়। যদিও সেখানে বিভাগীয় প্রার্থীর ক্ষেত্রে বয়স শিথিলযোগ্য করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের পূর্ব থেকে নিয়োজিত ড্রাইভারের আবেদন অগ্রাধিকার দেয়া হয় ও বিভাগীয় প্রার্থী দেখিয়ে বয়স প্রমার্জন করা হয়। এ ছাড়াও ১৭ জন ড্রাইভার নিয়োগে সব আবেদনকারীর আবেদন গ্রহণ বিবেচনায় না নিয়ে সামরিক ও আধাসামরিকবাহিনী হতে অবসরপ্রাপ্ত গণকর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। যাতে বিটিআরসির চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৯ লঙ্ঘিত হয়েছে।
দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ : শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও নেতার সুপারিশে ছাত্রলীগের পদধারীরা সহকারী পরিচালক ও অন্যান্য পদে নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন। অডিট রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিটিআরসির প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এম এ তালেব হোসেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের আপন ভাতিজা।
সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেসের উপপরিচালক থেকে এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন বিভাগে পরিচালক পদে তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পদোন্নতি বাগিয়েছেন। সরকারের অডিট অধিদফতর এ অনিয়ম বাতিল করে অতিরিক্ত বেতন ফেরতের সুপারিশ করলেও বাস্তবে তা উপেক্ষিত রয়ে গেছে। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদারের আসস্থাভাজন এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিরেক্টরেটের পরিচালক মো: নূরুন্নবী নিয়োগ বিধি ও বিটিআরসি চাকরি প্রবিধানমালা উপেক্ষা করে সিনিয়র সহকারী পরিচালক পদে লিখিত ও মোখিক পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সুপারিশে প্রশাসন বিভাগে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান তৌহিদুর নাহার। তিনি বর্তমানে সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের উপপরিচালক।
শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সুপারিশে স্পেকট্রাম বিভাগে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান সামিরা তাবাসসুম। বর্তমানে তিনি অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের উপপরিচালক হিসাবে রয়েছেন। মামাশ্বশুর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের সুপারিশে নিয়োগ পান প্রশাসন বিভাগে কর্মরত উপপরিচালক মো: মিরাজুল ইসলাম। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সুপারিশে সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান মাহরীন আহসান, যিনি বর্তমানে স্পেকট্রাম বিভাগের উপপরিচালক। সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের উপপরিচালক খালেদ ফয়সাল রহমানের নিয়োগ ছিল পুরোটাই অনিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, বয়স সংশোধন করে এবং কোনো লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই তিনি চাকরি পান। বাবা মফিজুর রহমান বাবলু ছিলেন কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি।
সুধা সদনের বিশেষ অনুরোধে এস এম গোলাম সারওয়ার লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগে যোগ দেন এবং বর্তমানে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শেখ হাসিনার এক সময়ের প্রটোকল অফিসার ও দ্বাদশ সংসদের এমপি আলাউদ্দিন নাসিমের শ্যালিকা শারমিন সুলতানা বর্তমানে স্পেক্ট্রাম বিভাগের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত। লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই চাকরিতে যোগ দেয়া, চাকরির বয়স পরিমার্জন এবং স্নাতকোত্তরের সনদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি; এসব অনিয়ম নিরীক্ষা ও মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে ফজলে নূর তাপসের সুপারিশে নিয়োগ পান সনজীব কুমার সিংহ। তিনি বর্তমানে অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগে উপপরিচালক। নিরীক্ষা অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিয়োগের শর্ত উপেক্ষা করে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি বিধিবহির্ভূতভাবে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান এবং পরে উপপরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু আওয়ামী পরিবারের সন্তান হওয়ায় প্রতারণার মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন বিভাগের উপপরিচালক নাফিসা মল্লিক। সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) পদে যোগ দিলেও তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির কোনো সনদ জমা দেননি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কারিগরি পদে তার যোগ্যতা নেই, ফলে নিয়োগ অবৈধ। তবুও কমিশন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাকে উপপরিচালক হিসাবে পদোন্নতি দিয়েছে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাদের সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন উপপরিচালক মো: আমজাদ হোসেন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে ওই সময় তিনি সারা দেশে ১০ হাজার লোক মাঠে নামানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন।
১৫ কর্মকর্তাসহ অভিযুক্তদের ওএসডি ও স্বাক্ষর ক্ষমতা রহিত করার সুপারিশ : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত, বিটিআরসিতে বিধিবহির্ভূতভাবে শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়োগ এবং অন্তত একডজন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২৯ জন প্রার্থী নিয়োগের মধ্যে ১৫ জন প্রার্থীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত চাকরির বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে আবেদন করার ও নিয়োগ পাওয়ার অযোগ্য। এর মধ্যে মো: এয়াকুব আলী ভূঁইয়া পদোন্নতির শর্ত হিসেবে উপপচিালক (এনফোর্সমেন্ট ও পরিদর্শন) পদে অনূন্য চার বছর চাকরির স্থলে ওই পদে ছয় মাস এক দিন শর্তপূরণ করেছেন, আফতাব মো: ওয়াদুদ পদোন্নতি শর্ত হিসেবে উপপরিচালক (পদ্ধতি ও সেবা) এক বছর ২২ দিন ও এম এ তালেব পদোন্নতির শর্ত হিসেবে উপপরিচালক (পদ্ধতি ও সেবা) তিন বছর ২৬ দিন পূরণ করেছেন, যা বিটিআরসির চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৯ (সংশোধিত)-এর ১১(১) প্রবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে।
উপপরিচালক আসাদুজ্জামান মাস্টার্স প্রোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নেয়া এবং শিক্ষাগতযোগ্যতা না থাকায় সহকারী পরিচালক পদে তাকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। শারমিন সুলতানাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান ও চাকরি স্থায়ীকরণের পর সিনিয়র সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়ায় বিধি লঙ্ঘণ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাদেরকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সংযুক্তিপূর্বক শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের যেকোনো সাইনিং পাওয়ার রহিতকরণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিটিআরসির সাবেক কমিশনার ড. মুশফিকের বিধিবহির্ভূত বেতন গ্রহণ : তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিটিআরসির সাবেক কমিশনার ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী সরকারের সাথে চুক্তি সম্পাদন না করে কমিশনার হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন যা নীতিবহির্ভূত। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে পত্র প্রেরণ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারের সাথে চুক্তি সম্পাদন ছাড়া কমিশনার পদে থেকে গৃহীত বেতনভাতাদি বাবদ তার কাছে বিটিআরসির পাওনা আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বিটিআরসির সাবেক মহাপরিচালক কুণ্ডুকে ডাক বিভাগের চিঠি : বিটিআরসির সাবেক মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুণ্ডকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রেরণ করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব ছাড়াই তিনি ওই চিঠির জবাব দেন তিন মাস পর ২১ ডিসেম্বর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবদুন নাসের খান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।