নিজস্ব প্রতিবেদক
- জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিচার
- মানবতাবিরোধী অপরাধ
সাবেক সেনাকর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে শতাধিক মানুষকে গুম ও পরবর্তীতে হত্যার অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। গতকাল বুধবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে আগামী ২১ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে, যা এই চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সাবেক এই উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তার বিরুদ্ধে শত শত মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া এবং গুম করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জিয়াউল আহসান তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইনবহির্ভূতভাবে অসংখ্য মানুষকে হত্যা ও গুমের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজেই এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন।
গতকাল সকালে প্রসিকিউটর শাইখ মাহদী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে সাবেক সেনাকর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, র্যাবের গোয়েন্দা শাখার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জিয়াউল আহসান শতাধিক মানুষকে গুম ও হত্যার সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বহস্তে অংশ নিয়েছেন। জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে গাজীপুরে তিনজনকে হত্যা, বরগুনার পাথরঘাটার চর-দুয়ানিতে ৫০ জনকে হত্যা এবং সুন্দরবনে বনদস্যু দমনের নামে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে আরো ৫০ জনকে হত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়াও, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী, সাজেদুল হক সুমন, সালাহউদ্দিন আহমেদসহ প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তিকে গুম ও হত্যার সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। অভিযোগ আমলে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামী ২১ ডিসেম্বর এ মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। গত ২৬ অক্টোবর এই মামলায় জিয়াউল আহসানসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এই ১১ আসামির মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও জিয়াউল আহসানের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
পরে সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে জানানোর সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে ৫০০-এর বেশি মানুষকে গুম করে হত্যা করার তথ্য এসেছে। এর মধ্যে ১০০-এর বেশি মানুষকে গুম করে হত্যার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও নজিরবিহীন পদোন্নতি : প্রসিকিউশনের দাখিল করা তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালে মেজর হিসেবে র্যাবে যোগদানের পর জিয়াউল আহসান দ্রুতই তৎকালীন সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। এই আস্থার ফলস্বরূপ, ২০২৪ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ পর্যন্ত তাকে কখনোই তার মাতৃবাহিনী, অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ফিরে যেতে হয়নি। তিনি সব সময়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন বাহিনী বা সংস্থায় কাজ করেছেন। অভিযোগ, পদোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় কোর্স বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করে এবং কোনো ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড বা ফরমেশন কমান্ডের অভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি মেজর জেনারেল পর্যন্ত পদোন্নতি পান, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবময় পেশাদারিত্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।
২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জিয়াউল আহসান র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক এবং পরবর্তীতে এডিজি (অপস্) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ে অসংখ্য বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অগণিত হত্যাকাণ্ড, গুমসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ তার সরাসরি নির্দেশ, অনুমোদনক্রমে অথবা তার জ্ঞাতসারে তার বিশ্বস্ত র্যাব সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হতো।
অভিযোগপত্রে উল্লিখিত সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনা : ১. গাজীপুরে তিনজনকে হত্যা (২০১১) : ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাত আনুমানিক ২৩:৩০ ঘটিকার দিকে র্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল আহসান ও তার দল পূর্বে থেকে র্যাবের অবৈধ হেফাজতে থাকা ভিকটিম সজলসহ তিন-চারজন বন্দীকে নিয়ে র্যাব সদর দফতর থেকে রওনা হন। ঢাকা বাইপাস রোড ধরে অগ্রসর হওয়ার পর জিয়াউল আহসানের নির্দেশে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় একজন বন্দীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিজেই গুলি করে হত্যা করেন। এরপর একই পন্থায় আরো দুই বন্দীকে নিজে অথবা তার নির্দেশে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশগুলো রাস্তার পাশে বা খালের মতো গর্তে ফেলে দেয়া হয়। পরে গাজীপুর জেলা পুলিশ গুলিবিদ্ধ দু’টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করে, যার মধ্যে একজনকে সজল হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
২. বরগুনায় ‘গেস্টাপো’ বা ‘গলফ’ অপারেশন (২০১০-২০১৩) : বরগুনা জেলার পাথরঘাটা থানাধীন চরদুয়ানী খাল বেয়ে বলেশ্বর নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট ও মোহনায় জিয়াউল আহসান কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের এক লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, র্যাবের গাড়িবহর গভীর রাতে আসত এবং স্থানীয় দোকানপাট বন্ধ করে লোকজনকে ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশ দিত, যা এলাকায় ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করত। রাত ১১টা বা তারও পরে কালো গ্লাসের মাইক্রোবাস, জিপ ও ডাবল কেবিন পিকআপে র্যাব সদস্যরা সাদা পোশাকে বন্দীদের নিয়ে আসত, যাদের মুখ ও হাত বাঁধা থাকত এবং মাথা কালো কাপড়ে ঢাকা থাকত। এসব বন্দীকে ট্রলার বা বোটে উঠিয়ে মাঝ নদীতে নিয়ে শরীরের সাথে বালিশ ঠেকিয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। এরপর তাদের পেট ছুরি দিয়ে ফেড়ে ফেলা হতো এবং সিমেন্টের ব্লক বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হতো। লাশ গুম করার এই প্রক্রিয়াটিকে তারা ‘গেস্টাপো’ বা ‘গলফ’ কোডনেম হিসেবে উল্লেখ করত। বরগুনায় সাবেক বিডিআর সদস্য নজরুল ইসলাম মল্লিক ও আলকাছ মল্লিকসহ কমপক্ষে ৫০ জনকে এই পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। একই পদ্ধতি ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মোহনা ও পতেঙ্গা উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরেও ব্যবহৃত হয়েছে।
৩. সুন্দরবনে ‘বনদস্যু দমনের নামে’ হত্যা (২০১০-২০১৩) : সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত বনদস্যু দমনের নামে জিয়াউল আহসান কিলিং মিশন চালিয়েছেন বলে অভিযোগ। আগে থেকে আটককৃত নিরাপরাধ বন্দীদের হত্যাকে বৈধতা দেয়ার লক্ষ্যে, পরিচিত বনদস্যুদের আটক করে গুম থাকা ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে গভীর রাতে পাথরঘাটার চরদুয়ানী থেকে ট্রলারে করে সুন্দরবনের পূর্বনির্ধারিত কথিত বনদস্যুদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হতো। র্যাব পূর্ব থেকেই সেখানে ঘর তৈরি করে হাঁড়ি-পাতিল, লুঙ্গি-গামছা, চাল-ডাল প্রভৃতি রেখে আস্তানা প্রমাণ করত। এরপর ভাগ্যাহত ভিকটিমদের চোখ ও হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হতো এবং উপর্যুপরি গুলিবর্ষণের মাধ্যমে একটি বন্দুকযুদ্ধের আবহ তৈরি করা হতো। কিছু ক্ষেত্রে অনুগত সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হলেও তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে হত্যাকাণ্ড চালানো হতো। পরে তাদের ঘটনাস্থলে নিয়ে মনগড়া ঘটনার বর্ণনা দেয়া হতো। এসব অভিযানে র্যাব-৮ (বরিশাল বিভাগ) ও র্যাব-৬ (খুলনা বিভাগ)-এর বাছাই করা সদস্যরা অংশ নিত। ‘অপারেশন নিশানখালী’ (মাসুদ ও মান্নান), ‘অপারেশন মরা ভোলা’ (জিহাদ, সোহাগ, আলামিন, আসাদ, বেলাল), ‘অপারেশন কটকা’ (শিশির কুমার মণ্ডল ওরফে মন্টু মেম্বার, বাচ্চু, জমাল মুন্সী ওরফে জামালসহ আটজন)- এ তিনটি অভিযানেই কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১০-১৩ সময়কালে ঢাকার শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে ‘গেস্টাপো’ বা ‘গলফ’ পদ্ধতিতে কমপক্ষে ২০০ জনকে হত্যা, ২০১০ সালে বিএনপি নেতা ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের গুম, ২০১২ সালে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীর গুম, ২০১৩ সালে ছাত্রশিবিরের আদাবর থানা সভাপতি হাফেজ জাকির হোসেনের গুম ও পরবর্তীতে হত্যা, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার নামে পরিচালিত অপারেশনের মাধ্যমে কমপক্ষে ৬১ জন নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা, ২০১৩ সালে বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ আরো সাত ব্যক্তির গুম, ২০১৫ সালে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম ও পরবর্তীতে ভারতে স্থানান্তর, এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের আন্দোলনের সময়ে ডিজিটাল নজরদারির মাধ্যমে অপহরণ, নির্যাতন, গুম ও হত্যার মাধ্যমে লাশ নিশ্চিহ্ন করে দেয়াসহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ডে জিয়াউল আহসানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে পৃথক তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।



