অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দীন হাসান

আইন না মেনে ভবন তৈরি করলে তা ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে

পুরো বাংলাদেশের ভূমিকম্পের বিশেষ মানচিত্র তৈরি করে তা সবাইকে দিতে পারে। ইতোমধ্যে একটি জোনাল মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এসব মানচিত্র আরো বিস্তারিতভাবে চিহ্নিত করে কোন এলাকায় ভবনের উচ্চতা কত হতে পারে তা নির্দিষ্ট করে ভবন তৈরির সময় জনগণকে মানতে বাধ্য করতে পারে। কেউ নির্দেশ অমান্য করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বেশি উচ্চতার ভবন তৈরি করলে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে পারে।

Printed Edition

৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে চারটি ভূমিকম্প হয়ে গেল দেশে। ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক মোটেও যায়নি। চারটি ভূমিকম্পের মধ্যে দুইটি ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি বেশ শক্তিশালী ছিল। ঢাকার খুবই কাছে হওয়ায় রাজধানীবাসীকে নাড়া দিয়ে গেছে। খোলা মাঠে ভূমিকম্পের তেমন ঝুঁকি নেই। কিন্তু অপরিকল্পিত ভবন তৈরি করলে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত আইন না মেনে ভবন তৈরি করলে তা ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি নিরাপদ শহর গড়ে তুলতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্টের যেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তেমনি রয়েছে নগর পরিকল্পনাবিদদের অবদান। মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য একটি নিরাপদ শহর গড়ে তুলতে হলে ভূমিকম্পবিষয়ক সচেতনতার কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দীন হাসান। এই বিষয়ে যে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নয়া দিগন্তের বিশেষ সংবাদদাতা হামিম উল কবির।

নয়া দিগন্ত : টাউন প্ল্যানিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্পে ঢাকার ঝুঁকিগুলো কী কী?

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দীন হাসান : ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে চারটি ভূমিকম্প হওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। টাউন প্ল্যানাররা মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য পরিকল্পনা করে থাকেন। তারা এমন পরিকল্পনা করেন যাতে মানুষ নিরাপদে জীবন-যাপন করতে পারেন। ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমানোর পরিকল্পনাও টাউন প্ল্যানাররা করে থাকেন। মোট কথা একটি নিরাপদ ও বাসপোযোগী শহর গড়ে তোলার কাজে তারা কাজ করেন। একই সাথে আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো দেখাও টাউন প্ল্যানারদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তারা এমন শহরের জন্য প্ল্যান করবেন যে শহরে মানুষ বসবাস করে সুখী বোধ করবেন। ঢাকার ভূমিকম্পের ঝুঁকিগুলো মোটামোটি এরকম : উচ্চ ঘনবসতি ও অনিয়ন্ত্রিত নগর সম্প্রসারণ; নির্মাণকাজে নিয়ম পালনে কমপ্রোমাইজ করা ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবন; দুর্ঘটনা ঘটলে পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনা কী হবে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই; রাস্তা ও হাসপাতাল সমস্যা; জনসাধারণের মধ্যে ভূমিকম্প সম্পর্কিত-ঝুঁকি জ্ঞান ও প্রস্তুতির ঘাটতি; বিশেষ করে ঢাকা শহরের মাটি আরেকটি সমস্যা ইত্যাদি।

নয়া দিগন্ত : ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি করতে বিএনবিসি ফলো করা বাধ্যতামূলক, কিন্তু তা সত্ত্বেও ঢাকাকে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ শহর বলা হচ্ছে কেন, যেখানে বিএনবিসির মতো একটি আইন আছে?

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দীন হাসান : একটি নিরাপদ শহর গড়ে তোলার জন্য টাউন প্ল্যানাররা কাজ করেন, এটা আগেই বলেছি। প্ল্যানাররা পরিকল্পনা করার সময় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মাথায় রেখেই নিরাপদ শহরের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ভবন তৈরির সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা যথাযথ না থাকায় অনেকে বিএনবিসি ফলো করছেন না, ফলে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন কম তৈরি হচ্ছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ভবন তৈরি করতে হলে আগেই একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করে নিতে হবে নগর কর্তৃপক্ষকে। সেই কাজটি করতে টাউন প্ল্যানাররা সাহায্য করে থাকেন। কিন্তু সব জায়গায় কি ভবন করা যাবে? অন্তত ঢাকা শহর অথবা সিলেট শহরের বেলায় বলব, প্ল্যান দেয়ার আগে ভূমিকম্পকে মাথায় রাখতে হবে। বিএনবিসিতে বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া আছে কিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু সব জায়গায় একই রকম ভবন তৈরি করা উচিত নয়। আমরা যদি জাপানের উদাহরণ সামনে আনি তাহলে দেখব, ভূমিকম্পপ্রবণ জাপানে হালকা ভবন তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে উঁচু ভবন হচ্ছে, ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় রেখেই করা হচ্ছে, তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা একটু ভিন্ন। এখানে মানুষ বেশি জায়গা কম। তা সত্ত্বেও কম জায়গার মধ্যেই পরিকল্পিত মজবুত ভবন তৈরি করা যায়। নিরাপদ ভবনের সাথে খোলা মাঠের কথা মাথায় রাখতে হবে যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সেখানে আশ্রয় নেয়া যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্যও খোলা জায়গা থাকা উচিত। যেনতেন জায়গায় নিরাপদ ভবন তৈরি করা যায় না। ৮ থেকে ১০ ফুট রাস্তায় ২০-২৫ তলা ভবন তৈরি করে ফেললে সেই ভবনটিই নিরাপত্তার যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনে তৈরি হলে সেটা ধসে পড়তে পারে অথবা হেলে পড়তে পারে। তখন এর আশপাশের ছোট ভবনগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। সে কারণেই ভবন তৈরির আগে, ‘নিয়ম মানা হচ্ছে কি না তা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে’।

নয়া দিগন্ত : নন ইঞ্জিনিয়ার্ড (ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে প্ল্যানবিহীন) ভবন নির্মাণ রোধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়?

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দীন হাসান : ঢাকা শহর বা বিভিন্ন স্থানে নন-ইঞ্জিনিয়ার্ড প্রচুর ভবন রয়েছে। নন-ইঞ্জিনিয়ার্ড ভবন করতে হলে কোনোভাবেই দু’তলার বেশি নির্মাণ করা যাবে না। এর বেশি উঁচু হলে একটু শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেই ধসে পড়তে পারে। তাহলে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার বেশি নন-ইঞ্জিনিয়ার্ড ভবন হলে তা পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষের উচিত ভেঙে দেয়া। অথবা এ ধরনের ভবন রেট্রোফিটিং সিস্টেমে নিরাপদ করা যায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ভবন মালিককে কিছু সময় দিয়ে তার ভবনটি নিরাপদ করার জন্য চেষ্টা করবে না হয় ভেঙে ফেলবে। ঢাকা শহরে রাজউকের সেই অবস্থা নেই। রাজউক ইচ্ছা করলে বেসরকারি ইনস্টিটিউশনগুলোকে দায়িত্ব দিতে পারে ভবনগুলো ইনস্পেকশন করে চিহ্নিত করতে। রাজউক এই বেসরকারি কোম্পানির ইন্সপেকশন করা ভবনগুলোতে দ্বৈচয়নের মাধ্যমে পরীক্ষা করবে, যে বেসরকারি কোম্পানির ইন্সপেকশন সঠিক হচ্ছে কি না। ইন্সপেকশন করে বেসরকারি কোম্পানি নির্দিষ্ট ফি আদায় করতে পারবে। রাজউকের পরীক্ষায় সঠিক কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে ফেক সার্টিফিকেট দেয়ার প্রমাণ পেলে বিরাট অঙ্কের অর্থ জরিমানার বিধান রাখতে হবে যেন কোম্পানি নিরাপত্তা ফেক সার্টিফিকেট দেয়ার উৎসাহ না পায়।

নয়া দিগন্ত : ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে কি পদক্ষেপ নেয়া যায় ?

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দীন হাসান : শুধু ঢাকা শহর নয়, সারা দেশেই ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে সরকার বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। পুরো বাংলাদেশের ভূমিকম্পের বিশেষ মানচিত্র তৈরি করে তা সবাইকে দিতে পারে। ইতোমধ্যে একটি জোনাল মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এসব মানচিত্র আরো বিস্তারিতভাবে চিহ্নিত করে কোন এলাকায় ভবনের উচ্চতা কত হতে পারে তা নির্দিষ্ট করে ভবন তৈরির সময় জনগণকে মানতে বাধ্য করতে পারে। কেউ নির্দেশ অমান্য করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বেশি উচ্চতার ভবন তৈরি করলে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে পারে। সম্ভাব্য নগর কেন্দ্রকে ছোট ও মাঝারি শহরে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেই লক্ষ্যে বিনিয়োগ করতে হবে এবং বেসরকারিভাবে উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে যেন সম্ভাব্য ভূমিকম্পে ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়।