ব্রয়লার মুরগির ওজন যত বেশি স্বাদ তত ভালো

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে সাধারণত ২৫-২৮ দিন বয়সী ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেন বেশির ভাগ খামারি। কিন্তু ব্রয়লার মুরগি ৩২ দিনের বেশি বয়স হলে যেমন ওজন বাড়ে, তেমনি স্বাদও ভালো হয়। ওজন বৃদ্ধির কারণে খামারি যেমন লাভবান হন, তেমনি ভোক্তাও লাভবান হন।

কাওসার আজম
Printed Edition
  • বর্তমানে ২৮ দিনের মধ্যেই বেশির ভাগ ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়
  • মুরগির বর্জ্য থেকে পোলট্রি মিল তৈরির সুযোগ

একসময় ব্রয়লার মুরগি খাওয়া নিয়ে মানুষের মনে নানা ধরনের সংশয় তৈরি হলেও দিন দিন আরো জনপ্রিয় হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম ব্রয়লার মুরগি ছাড়া পাতে যেন ভাতই নিতে চায় না। অনেক দিন ধরেই বাণিজ্যিকভাবে দেশে ব্রয়লার মুরগি লালন-পালন করা হয়। ছোট ছোট খামারের পাশাপাশি বেশকিছু বড় খামারও গড়ে উঠেছে। যারা মুরগির বাচ্চা তৈরি থেকে শুরু, করে ডিম উৎপাদন ও ফিডও তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে সাধারণত ২৫-২৮ দিন বয়সী ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেন বেশির ভাগ খামারি। কিন্তু ব্রয়লার মুরগি ৩২ দিনের বেশি বয়স হলে যেমন ওজন বাড়ে, তেমনি স্বাদও ভালো হয়। ওজন বৃদ্ধির কারণে খামারি যেমন লাভবান হন, তেমনি ভোক্তাও লাভবান হন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভ্যাটেরিনারি মেডিসিন ফ্যাকল্টির ডিন অধ্যাপক ড. মো: আনোয়ারুল হক বেগ নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্রয়লার তো বাণিজ্যিকভাবে লালন-পালন করা হয়। তিন সপ্তাহ পার হলেই ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেন খামারি। তবে, সাধারণত চার সপ্তাহ পরেই বাজারজাত বেশি হয়। বেশি ওজনের ব্রয়লারে খামারির পাশাপাশি ভোক্তাও বেশি লাভবান হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধরুন- এক কেজি ওজনের দু’টি ব্রয়লার কিনলেন, এতে নাড়িভুঁড়ি বা অন্যান্য বর্জ্য ফেলার পর ভোক্তা এক হাজার ৫০০ গ্রাম বা দেড় কেজি পরিমাণ গোশত পাবেন। অর্থাৎ প্রায় ৫০০ গ্রাম বর্জ্য চলে যাবে। অন্য দিকে দুই কেজি সাইজের একটি ব্রয়লারের বর্জ্য হবে ৩০০ গ্রাম। ভোক্তা এক হাজার ৭০০ গ্রাম গোশত পাচ্ছেন। অর্থাৎ বড় সাইজের ব্রয়লার কিনলে ভোক্তার লাভ হচ্ছে বেশি। তিনি বলেন, চার সপ্তাহের পরে যত দিন যাবে ব্রয়লার মুরগির গোশত তত টেস্টি হবে। গোশত সফট থেকে একটু হার্ড হয়। এটাই ভালো। তবে, এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, গরমের সিজনে হার্ট অ্যাটাক বেশি বা হিট স্ট্রোকে ব্রয়লারের মৃত্যুহার বাড়তে পারে। সে জন্য চার সপ্তাহের পর খামারি আর খামারে মুরগি রাখতে চান না, বিক্রি করে দেন। যাদের ভেন্টিলেশন সিস্টেম ভালো তারা রাখতে পারেন।

বয়সে বড় ব্রয়লার মুরগির গোশত অনেক বেশি স্বাদযুক্ত হওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোশতের গঠন ও ঘনত্ব (মিট টেক্সচার অ্যান্ড ডেনসিটি) বেশি। কম বয়সী ব্রয়লারের গোশত অনেক নরম ও পানি ভর্তি হয়, কারণ তা দ্রুত বাড়ে। বয়স বাড়লে গোশতের ফাইবার ঘন হয় এবং প্রেটিন কনটেন্ট বাড়ে, ফলে তা বেশি স্বাদযুক্ত হয়।

তারা বলছেন, বড় বয়সের ব্রয়লারে চর্বি একটু বেশি জমে, বিশেষ করে স্কিন ও গোশতের আশপাশে। এই চর্বি থেকেই রান্নার সময় ‘চিকেনি ফ্লেভার’ বা গাঢ় স্বাদ তৈরি হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বয়সী মুরগি সাধারণত খাবার ভালোভাবে হজম করে বলে ভালো টিস্যু ডেভেলপ করে। এটি তাদের গোশতকে আরো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক স্বাদযুক্ত করে তোলে। বয়সী মুরগির গোশতে মেইলার্ড রিঅ্যাকশন ভালো হয়, অর্থাৎ রান্নার সময় এর উপরিভাগে ভালো ব্রাউনিং হয়, যা স্বাদ বাড়ায়। বাজারের খুব কম বয়সী ব্রয়লার মুরগির মধ্যে পানি বেশি থাকে, ফলে রান্নার সময় গোশত অনেকটাই শুকিয়ে যায় এবং স্বাদ কম লাগে।

ব্রয়লার মুরগির ছোট বয়সে শুধু ওজন ফোকাস থাকে। বড় বয়সে ওজন + গোশতের গঠন + ফ্যাট ডিপোজিশন + টেক্সচার’ এসব একসাথে বিবেচনায় আসে। সবকিছু বিবেচনা করে ৩০ দিনের বেশি পালন করে দুই থেকে আড়াই কেজি ওজন হলে ব্রয়লার মুরগি বাজারজাত করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. মো: শওকত আলী নয়া দিগন্তকে বলেন, বিভিন্ন দেশে ব্রয়লার মুরগি আড়াই কেজি বা তারও বেশি ওজনের চাহিদা বেশি। আমার মনে হয়, ব্রয়লারের বয়স ৩৫-৪২ দিন হলে গোশতের ফাইবারটা ভালো হয়, টেস্ট বেশি হয়।

ছোট সাইজের ব্রয়লার খেলেও স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনি কিভাবে লালন-পালন করছেন, কী খাওয়াচ্ছেন ব্রয়লারকে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বড় বড় যে পোলট্রি ফার্ম আছে, যারা খাদ্য উৎপাদন করে তা নিরাপদ। তারা যে ফিড উৎপাদন করছে, তাতে কোনো ভেজাল নেই। ইন্ডিয়াতে যে ফিড তৈরি হয় তার চেয়েও ভালো। কারণ ওরা ফিডে গ্রথ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের দেশে তো নিষিদ্ধ। আমাদের ব্রয়লারের গোশত অনেক সেফ। বাংলাদেশে ছোট ছোট খামারি গ্রথ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে কি না জানা নেই। তবে, আমাদের দেশের বড় বড় ফিড উৎপাদনকারীর খাদ্যমান অনেক ভালো।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ (বাকৃবি)-এর ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: মাহমুদুল হাসান শিকদার বলেন, ব্রয়লার মুরগির চেয়ে দেশে সোনালি মুরগির বিক্রি বাড়ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ব্রয়লার মুরগির স্বাদ-গন্ধ কিছুটা কমে গেছে। ব্রয়লার মুরগি যদি একটু বয়স বাড়িয়ে বিক্রি করা যায়, যেমন ২৫ দিনে বিক্রি না করে ৩৬-৪০ দিন বয়সে বিক্রি করা যায় তাহলে তার স্বাদ,গন্ধ এবং টেক্সচার বাড়বে। বেশি বয়সে বিক্রি করলে ব্রয়লারের টেক্সচার এবং স্বাদ বাড়ে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাজারে জীবন্ত মুরগি বিক্রি না করে ফ্রোজেন মুরগি বিক্রি করলে ভোক্তা এবং খামারি উভয়েই লাভবান হবে। শ্রীলঙ্কায় কোনো লাইফবার্ড মার্কেট নেই। তবে, বাংলাদেশে হিমায়িত গোশতের প্রতি গ্রাহকের বিশ্বস্ততা গড়ে ওঠেনি। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে উঠলে ভোক্তার যেমন সঠিক মাপের গোশত পাওয়া নিশ্চিত হবে তেমনি মুরগির বর্জ্য থেকে পোলট্রি মিল তৈরি হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিমায়িত মুরগি দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায়, যা জীবন্ত মুরগির চেয়ে বেশি সুবিধাজনক। এতে সরবরাহ ও চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি করা সহজ হয়।

পোলট্রি মিল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোলট্রি মিল হলো জবাই করা মুরগির মৃতদেহ থেকে তৈরি একটি গুঁড়া, যা পুষ্টির জন্য পোলট্রি খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। এটি তৈরি করতে মুরগির মাথা, পা, হাড় এবং অব্যবহৃত অংশকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। মুরগির এই অব্যবহৃত অংশগুলোকে উচ্চ তাপে রান্না বা চাপ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রক্রিয়াজাত অংশগুলোকে শুকিয়ে মিহিগুঁড়ায় পরিণত করা হয়। এটি মূলত পোলট্রি খাদ্যের প্রোটিনের একটি উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লাইফবার্ড মার্কেট যদি না থাকে তাহলে মুরগি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রসেস করা হবে এবং মুরগির বর্জ্য যেখানে সেখানে পড়ে থাকবে না। বর্জ্যগুলো নির্দিষ্ট কারখানায় নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হবে। এর ফলে বাজারের পরিবেশও অনেক স্বাস্থ্যকর হবে।