মালয়েশিয়ায় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি বেপরোয়া

‘‘শ্রমবাজার উন্মুক্তের সময় বাংলাদেশী দেড় শ’ কর্মীর সত্যায়নে অনুমোদন দিতে মালয়েশিয়ার একটি চাইনিজ কোম্পানির কর্মকর্তার কাছে তার হয়ে তার এক কথিত মামা ৩০ হাজার রিংগিট ঘুষ দাবি করেছিলেন। এরপর থেকেই জাহিদুর রহমান ব্যাপক আলোচনায় আসেন।’’

মনির হোসেন
Printed Edition
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাস
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাস |সংগৃহীত

  • ‘চাইনিজ কর্মকর্তার কাছে ৩০ হাজার রিংগিট ঘুষ দাবি’
  • তদন্ত প্রতিবেদনেও ধামাচাপা

মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি এ এস এম জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে বেপরোয়া আচরণ করার অভিযোগ অনেক পুরনো। তিনি কাউকে পাত্তা না দিয়ে সমান তালেই অনিয়ম, দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার কর্মকাণ্ডে হাইকমিশনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ কমিউনিটির অনেকেই অতিষ্ঠ। তারপরও তিনি থামছেন না। শ্রমবাজার উন্মুক্তের সময় বাংলাদেশী দেড় শ’ কর্মীর সত্যায়নে অনুমোদন দিতে মালয়েশিয়ার একটি চাইনিজ কোম্পানির কর্মকর্তার কাছে তার হয়ে তার এক কথিত মামা ৩০ হাজার রিংগিট ঘুষ দাবি করেছিলেন। এরপর থেকেই জাহিদুর রহমান ব্যাপক আলোচনায় আসেন। পরবর্তীতে চাইনিজ ওই কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ হয়ে জাহিদের বিরুদ্ধে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করা হলে ঘুষ চাওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়। এই ঘটনার এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে অদ্যাবধি শাস্তিমূলক কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো তিনি ওই তদন্ত প্রতিবেদনটিই ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছেন।

জানা যায়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীর প্রথম সচিব জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসানের কাছে। এর অনুলিপি দেয়া হয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আমিন (বদলি) এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও (পূর্ব)। কিন্তু এখনো তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেয়ায় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা ও প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেকেই নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

গত সপ্তাহে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে হাইকমিশনের প্রথম সচিব জাহিদুর রহমানের গোপনীয় তদন্ত প্রতিবেদনটি নয়া দিগন্তের হাতে আসে। তদন্ত কমিটির প্রধান ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন এ এস এম জাহিদুর রহমান ২০২২ সালে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগদান করেন। শ্রমবাজার উন্মুক্ত হলে হাইকমিশনের অনুবিভাগের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কারণ, তখন অসংখ্য কোম্পানি পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিতে হয়। এসব রিপোর্টের ভিত্তিতেই সত্যায়ন দেয়া হয়। শ্রম অনুবিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে জাহিদকেও একাজে সম্পৃক্ত করা হয়। এই কর্মযজ্ঞ চলার সময় জাহিদ মি. রবিন নামের নিজের মামাকে মালয়েশিয়াতে নিয়ে আসেন। তাকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের স্টাফ পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্টদের সাথে পরিচিত করে দাফতরিক কাজে সম্পৃক্ত করেন তিনি। তৎকালীন মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনার এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পান। এই অভিযোগের প্রমানক হিসেবে জাহিদের মামার একটি অডিও, তার নিজের একটি অডিও এবং তার মামার একটি ছবি সংযুক্ত করে দেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অডিওতে তার মামা ওই কোম্পানির কর্মকর্তার কাছে নিজেকে হাইকমিশনের স্টাফ হিসেবে পরিচয় দেন এবং দেড়শ’ জন কর্মী নিয়োগের জন্য সত্যয়নবাবদ প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা (মালয়েশিয়ান মুদ্রায় ৩০ হাজার রিংগিট) দাবি করেন। টাকার পরিমাণ নিয়ে ব্যাপকভাবে দেনদরবার করেন মর্মে অডিও শুনে প্রতীয়মান হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আরো বলা হয়, একই ব্যক্তি একই বিষয়ে জাহিদকে টেলিফোন করেন। তাদের দীর্ঘ সময়ের এ কথোপকথনে জাহিদ দাফতরিক গোপনীয় তথ্য শেয়ার করেন এবং তার মামার পরিচয় দফতরের কর্মচারী হিসেবে স্বীকার করেন। তাদের এই কথোপকথন দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট দালিলিক প্রমাণ বহন করে বলে প্রতীয়মান হয়। হাইকমিশন তখন জাহিদের মামার পরিচয় নিশ্চিত হতে শ্রম অনুবিভাগের কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর সাহায্য নেয়। তারা এই ব্যক্তিকে জাহিদের মামা হিসেবে চিহ্নিত করেন। কারণ প্রটোকল সহকারী (শ্রম অনুবিভাগের কল্যাণ সহকারী মোকসেদ আলী) ওই ব্যক্তিকে মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে রিসিভ করতে গিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে জাহিদ এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ ঘটনার পর তৎকালীন হাইকমিশনার মৌখিকভাবে এ ধরনের কাজের জন্য তাকে সর্তক করেন এবং লঘু দণ্ড হিসেবে সত্যায়নের কাজ থেকে জাহিদকে বিরত রাখেন। তদন্ত প্রতিবেদনে ডেপুটি হাইকমিশনার উল্লেখ করেন, জাহিদ পরবর্তীতে পূর্বের হাইকমিশনার বদলি হলে কথিত এক দালাল সাংবাদিকের মাধ্যমে (যার নামে মিশনের কাছে মানব পাচার/অনৈতিকভাবে অসহায় বাংলাদেশীদের কাছ থেকে অভিবাসনের নামে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে) সংবাদ প্রকাশ করান এবং চিহ্নিত কিছু ব্যক্তির (যারা দালাল হিসেবে পরিচিত) মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালান। পরবর্তীতে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে হাইকমিশন এ ধরনের অভিযোগ তদন্ত করে এবং এর কোনো সত্যতা পায়নি। পরবর্তীতে জাহিদ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে তার বন্ধু/সহকর্মীদের মাধ্যমে এসব মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে নজিরবিহীনভাবে মিশন কর্তৃক স্থানীয়ভাবে নিয়োগ করা কর্মচারীদের বরখাস্ত করার মাধ্যমে তার নিজের অপকর্মকে ঢাকার জন্য এসব নিরীহ কর্মচারীদের অপূরণীয় ক্ষতি করিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়!

গতকাল শুক্রবার তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীরের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি তদন্ত করে যা পেয়েছি তা প্রতিবেদনে দিয়েছি। এরবাইরে আমার কোনো মন্তব্য নেই।

এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে (সেক্রেটারি) মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব এ এস এম জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ই মেইলে লিখিত অভিযোগ পাঠান মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী কোম্পানি চিচু সার্ভিস এসডিএন বিএইচডির পরিচালক মি. চিচু জন মি। তিনি উল্লেখ করেন, মালয়েশিয়ায় আমাদের কিছু বাংলাদেশী বন্ধু আছে। আমার সি লাইসেন্স আছে। যখন আমরা মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে চাহিদাপত্রের সত্যায়নের জন্য যাই, তখন দুর্ভাগ্যবশত ফার্স্ট সেক্রেটারি জাহিদ তার কক্ষের দরজা বন্ধ করে আমাদের সাথে কথা বলতে চান। তারপর তিনি আমাদের অপ্রত্যাশিতভাবে প্রশ্ন করতে থাকেন। কে বাংলাদেশী এজেন্ট, কে মধ্যম ব্যক্তি এবং আমরা কোনো এজেন্টের কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছি এসব কথা জানতে চান। তারপর তিনি আমাদের তার নম্বর দেন এবং অফিস সময়ের পর কথা বলার পরামর্শ দেন। তারপর তিনি পরোক্ষভাবে সত্যায়নের জন্য টাকা নেন এবং তিনি বলেন, কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। এই বিষয়ে আমরা শ্রম কাউন্সেলর শরীফের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। দেখা করার চেষ্টা করেছি। সাক্ষাৎও দেননি। আমি আশা করি আপনি আপনার অভিবাসী কর্মীদের উন্নতি এবং নতুন কর্মীদের কর্মসংস্থানের জন্য আপনার মিশন অফিসারদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দেবেন বলে চিঠির অভিযোগে উল্লেখ করেন তিনি।

গতকাল সন্ধ্যার আগে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইককিশনের প্রথম (শ্রম) সচিব এ এস এম জাহিদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাথে সাথে লাইন কেটে দেন। এরপর তিনি একটি বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন, প্লিজ সেন্ড মি এসএমএস। আই এম অন লিভ নাউ। এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনার শামীম আহসানের সাথে যোগাযোগ করে জাহিদুর রহমানের বিষয়ে বক্তব্য চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।