বিশেষ সংবাদদাতা
রাষ্ট্রীয়খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক সময় সেরা ছিল জনতা ব্যাংক। কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক ডাকাতদের ঋণের নামে লুটপাটের ঘটনায় এটি মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকটি এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নাজুক অবস্থানে চলে গেছে। আর এর মূলে রয়েছে পতিত সরকারের আস্থাভাজন ও তহবিল জোগানদাতা বেক্সিমকো, এস আলম, নাসা, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, থার্মেক্স ও সিকদার গ্রুপ। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ একাই ব্যাংকটি থেকে ঋণের নামে বের করে নিয়েছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা আর এস আলম নিয়েছিল প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকো ও এস আলম ব্যাংকের এক টাকাও ফেরত দেয়নি। কিন্তু এখন ব্যবসা চালানোর জন্য বেক্সিমকো গ্রুপ ৪০০ কোটি টাকা ব্যাক টু ব্যাংক ঋণ সুবিধা চেয়েছে জনতা ব্যাংকের কাছে। এমনি পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বেক্সিমকো গ্রুপকে ঋণ দেয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে জনতা ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এ খেলাপি ঋণ মোট ঋণের প্রায় ৬৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংকটির এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা ব্যাংকটি থেকে ঋণ নিয়েছিল তারা বলতে গেলে কেউই ঋণ পরিশোধ করছে না। পতিত প্রধানমন্ত্রীর শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের গ্রুপই ঋণ নিয়েছে সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কোনো অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। ব্যাংকখেকো এস আলম এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকসহ ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন। যার বেশির ভাগ অর্থই পাচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে এখন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। জনতা ব্যাংক একাধিকবার বেক্সিমকো ও এস আলমের সম্পদ নিলামে তুলে ঋণ সমন্বয়ের চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু মাফিয়া এ দুই গ্রুপের সম্পদ কেনার মতো কোনো গ্রাহক পাওয়া যায়নি বলে জনতা ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে। এখন উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বেড়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ব্যাংকটির এমনি নাজুক পরিস্থিতিতে এক টাকা পরিশোধ না করেও নতুন ৪০০ কোটি টাকা ঋণের আব্দার করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানিয়েছে, গ্রুপটি পরিচালনা ব্যয় মেটাতে স্বল্পমেয়াদি অর্থায়ন হিসাবে ৪০০ কোটি টাকার ক্যাশ ক্রেডিট (সিসি) চেয়েছে জনতা ব্যাংকের কাছে। বেক্সিমকো টেক্সটাইলের গৃহীত ঋণ পরিশোধে ব্যাক টু ব্যাংক ঋণ সুবিধা চাওয়া হয়েছে। এ জন্য জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান রিভাইবাল জাপান, বেক্সিমকো গ্রুপ ও জনতা ব্যাংকের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করা যায় কি না এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জনতা ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে। জনতা ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ত্রিপক্ষীয় চুক্তির সম্ভাব্যতা নিয়ে কমিটি পর্যালোচনা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
তবে, যে প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাংকটি ডুবতে বসেছে ওই প্রতিষ্ঠানকে আর কোনো ঋণ সুবিধা দেয়া ঠিক হবে কি না সে বিষয়ে আরো যাচাই করা প্রয়োজন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ যে প্রতিষ্ঠান আটকে রেখেছে এখন ব্যাংকটি রক্ষার জন্য প্রয়োজন ওইসব ঋণ আদায়ের জন্য আগে চেষ্টা করা। বেক্সিমকো গ্রুপ যে অর্থ বিদেশে পাচার করেছে ওইসব অর্থ দেশে ফিরে এনে ঋণ সমন্বয় করতে হবে। একই সাথে বেনামে দেশে কোনো অর্থ মজুদ আছে কি না তা যাচাই করতে হবে। অন্যথায় জনতা ব্যাংকের দুর্দশা আরো বেড়ে যাবে, বৈ কমবে না।



