শীতের ভোরে জেগে ওঠা পাখিদের ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর

চার দিকে শুধু অতিথি পাখির কলরব, পানির ওপর ভেসে থাকা তাদের দুষ্টুমির ঢেউ, আর আকাশজুড়ে ডানার মৃদু শব্দ। ঢাকার ব্যস্ততা থেকে খুব সহজেই ঘুরে আসা যায় এই নির্মল প্রকৃতির কোলে, যেখানে সবুজে মোড়া বিশাল ক্যাম্পাস আর গাছপালায় ঢাকা পথগুলো যেন এক নীরব বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতি দেয়।

Printed Edition
শীতের আগমনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেশী-বিদেশী পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে
শীতের আগমনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেশী-বিদেশী পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে |নয়া দিগন্ত

আমির ফয়সাল জাবি

শীতের শুরুতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ক্যাম্পাস যেন হঠাৎ করে বদলে যায়, চার দিকে শুধু অতিথি পাখির কলরব, পানির ওপর ভেসে থাকা তাদের দুষ্টুমির ঢেউ, আর আকাশজুড়ে ডানার মৃদু শব্দ। ঢাকার ব্যস্ততা থেকে খুব সহজেই ঘুরে আসা যায় এই নির্মল প্রকৃতির কোলে, যেখানে সবুজে মোড়া বিশাল ক্যাম্পাস আর গাছপালায় ঢাকা পথগুলো যেন এক নীরব বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতি দেয়।

এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন ‘পাখিদের ক্যাম্পাস’ বলা হয়। উত্তর খুঁজতে গেলে শীতের ভোরের এক টুকরা নরম আলোয় ডুবে থাকা লেকপাড়ে দাঁড়ালেই হবে। অগ্রহায়ণের হিমেল হাওয়া নামতেই সুদূর সাইবেরিয়াসহ নানা দেশের আকাশ পেরিয়ে যেসব অতিথি পাখি এখানে এসে আশ্রয় নেয়, তাদের ডানার ঝাপটায় যেন পুরো ক্যাম্পাস জেগে ওঠে এক অন্যরকম প্রাণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি লেকের মধ্যে কয়েকটি লেক তো শীতের মৌসুমে রীতিমতো পাখিদের উৎসবের আসরে পরিণত হয়। হাজারো পাখি দল বেঁধে খেলা করে, পানিতে ভাসে, ডুব দেয়, আবার কখনো আকাশভরা শঙ্খচিলের মতো ওড়াউড়িতে রঙিন করে তোলে নীল বিস্তার।

সবুজে মোড়া এই ক্যাম্পাস যেন তাদের জন্যই সাজানো শেষ প"ষ্ঠার পর

এক আশ্রয়¯'ল, নীরব লেক, গাছের সারি, আর্দ্র বাতাস আর শান্ত পরিবেশ পাখিদের নিরাপদ থাকার সবটুকু নিশ্চয়তা দেয়। আর সেই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই প্রতি বছর প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘পাখি মেলা’। এই মেলা শুধু আনন্দ নয়, পাখি সংরণ আর সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেয় দূর-দূরান্ত পর্যন্ত।

ঢাকার এত কাছে হয়েও যেন এক মায়াবী বন্যসৌন্দর্যের রাজ্য, তাই শীত এলেই দর্শনার্থীদের ভিড় জমে এখানে। কেউ আসেন ক্যামেরা হাতে, কেউ শুধু নির্জনতা খুঁজতে। কিš' সবাইকে এক সুরে বিমোহিত করে পাখিদের জলকেলি, বাতাসে ওড়াউড়ি আর প্রকৃতির অবি"েছদ্য, মু"কর ছন্দ। জাহাঙ্গীরনগর তাই শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এ এক জীবন্ত পাখির রাজ্য, যেখানে প্রতিটি শীতেই ডানায় ডানায় লেখা হয় ফেরার গল্প।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখিদের ইতিহাস যেন এক দীর্ঘ, মায়াময় ঋতুচক্রের গল্প। ১৯৮৬ সালে ক্যাম্পাসের লেকে প্রথমবারের মতো পরিযায়ী পাখির দেখা মিলেছিল। সেই একটি শীতের আগমন বার্তা জাবির প্রকৃতিকে এমনভাবে বদলে দিয়েছিল যে, এর পর থেকে প্রতি বছরই তারা ফিরে এসেছে ডানার ডাকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপরে যতœ, শিার্থীদের সচেতনতা আর সবুজে ভরা নীরব পরিবেশ মিলেই জাহাঙ্গীরনগরকে গড়ে তুলেছে অতিথি পাখিদের শীতকালীন নিরাপদ আশ্রয়¯'ল হিসেবে।

প্রাণিবিদ্যা বিভাগের জরিপ বলছে, আশির দশকে যখন প্রথম পাখির সমাগম শুরু হয়, তখন ক্যাম্পাসে পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৯০ প্রজাতির পাখির। সময়ের সাথে সাথে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০-তে। এর মধ্যে ১২৬ প্রজাতি দেশীয় এবং ৬৯ প্রজাতি অতিথি পাখি। আরো আশার ব্যাপার কয়েকটি প্রজাতির পাখি এখন সারা বছরই ক্যাম্পাসে থাকে, যেন জাহাঙ্গীরনগরই হয়ে উঠেছে তাদের ¯'ায়ী নিবাস।

তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শঙ্কার কথাও উঠে আসছে শিার্থীদের মুখে। তারা জানায়, গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসে পাখির সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। লেকগুলোর চারপাশে ব্যানার, ফেস্টুন, সতর্কবার্তা সাইনবোর্ড থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য দর্শনার্থী এখনো গাড়ি নিয়ে চলে আসেন। পাখিদের নিরিবিলি পরিবেশ ব্যাহত হওয়ায় অনেক প্রজাতি বিরক্ত হয়ে আসা কমিয়ে দি"েছ বলে মনে করছেন গবেষকরা। মানুষের অযতœ আর অজ্ঞতা তাই হয়ে উঠছে পাখিদের জন্য অদ"শ্য আতঙ্ক।

তবুও আশার আলো জ্বলে উঠেছে কিছু উদ্যোগে। জাবি কেন্দ্রীয় শিার্থী সংসদ (জাকসু) এ বছর পাখিদের অন্যতম প্রধান আশ্রয় মনপুরা লেকসহ বিভিন্ন লেকে বিশেষ মাচা তৈরি করেছে, যেখানে পাখিরা নির্বিঘেœ বিশ্রাম নিতে পারে। পাশাপাশি আরো কিছু সংরণমূলক পদপে নেয়া হয়েছে, যাতে অতিথি পাখিরা আবার আগের মতো নিশ্চিন্তে ফিরে আসতে পারে এই সবুজ ক্যাম্পাসে।

প্রতিটি শীতেই জাহাঙ্গীরনগর নতুন করে অপোয় থাকে তাদের ডানাওলা অতিথিদের। আর যতদিন প্রকৃতি ও মানুষ মিলে এই আশ্রয় রা করবে, ততদিন জাবি থাকবে পাখিদের ওড়াউড়িতে মুখর, এক সত্যিকারের জীবন্ত অভয়ারণ্য হয়ে।

Topics