আড়াই হাজার কোটি টাকার বহুল আলোচিত ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ শেষ পর্যন্ত নানা অনিয়ম, জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়েই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সাত বছর আগে যাত্রা শুরু করা মৎস্য অধিদফতরের এ বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবে তেমন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি; বরং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভুয়া বিল ভাউচার, পরামর্শক জালিয়াতি, গাড়ি ভাড়া অনিয়ম, ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ, বিদেশ সফরের নামে টাকা লোপাট, টেন্ডারে জালিয়াতি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ প্রায় সব ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্পটি ডুবানোর অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্টে শুধু এ প্রকল্পেই ২৫৮ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম শনাক্ত হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক মো: জিয়া হায়দার চৌধুরী ও সাবেক মহাপরিচালকসহ মৎস্য অধিদফতরের একাধিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং বিগত দিনে এ প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব পালন করে আসা সবার বিরুদ্ধেই এসব অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুদকের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানেও তাদের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের তথ্য উঠে এসেছে।
দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে, প্রকল্প পরিচালক জিয়া হায়দার চৌধুরী পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে নিয়মিত টেন্ডার প্রক্রিয়া প্রভাবিত করতেন। শীর্ষ দরদাতার কাগজপত্রে ত্রুটি দেখিয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ বুঝিয়ে দেয়া ছিল তার চিরাচরিত পদ্ধতি। প্রতিটি টেন্ডারের পেছনে তিনি দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত কমিশন নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। নতুন টেন্ডার এলেই ইচ্ছাকৃত সময়ক্ষেপণ করে প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলা হতো। কক্সবাজারের নামসর্বস্ব ‘এমকেএ হ্যাচারি’র সাথে ভুয়া চুক্তি করে সরকারি কোষাগার থেকে দুই কোটি ৫৬ লাখ টাকার চেক ছাড় করা হয়, যেখানে প্রকল্প পরিচালক ছাড়াও সাবেক মহাপরিচালক জিল্লুর রহমানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। তদন্তে জানা গেছে, সাত কোটি টাকার কাজ মাত্র পাঁচ কোটি টাকায় অনুমোদন দিয়ে অভিযোগের জটিলতা আরো বাড়ান জিয়া হায়দার। কক্সবাজারের একটি হ্যাচারির কাজও বিপুল ঘুষের বিনিময়ে সাবেক এক এমপিকে পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ২০২৪-এর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পজুড়ে গোপন থাকা জালিয়াতির সব চিত্র সামনে আসে। তৎকালীন মহাপরিচালক জিল্লুর রহমানকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং পরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান বলে জানা যায়। দুদক এরপর থেকেই প্রকল্পের বিস্তৃত দুর্নীতি অনুসন্ধান শুরু করে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, জিয়া হায়দারের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার ‘শহীদ ঠিকাদার’ এবং ‘হাওলাদার ঠিকাদার’ চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখে নিয়মিত তাকে কমিশন দিত। শুধু ইলিশ-সংক্রান্ত প্রকল্পেই শহীদ ঠিকাদারের কাজের অংশ ৯০ শতাংশের বেশি ছিল বলে জানা গেছে। নোয়াখালীর কোস্টগার্ড নির্মাণ, কক্সবাজারের কলাতলী ঘাটসহ আরো বহু কাজ একই সিন্ডিকেটকে দেয়া হয়। এ নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে নিউজও প্রকাশিত হয়েছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ৫০ হাজার পিস সামুদ্রিক চিংড়ি রেণু পোনা (পিপিএল) যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ড থেকে কেনার নামে পাঁচ কোটি ৫২ লাখ টাকার ভুয়া লেনদেনের তথ্য। বাস্তবে বিদেশ থেকে কোনো পোনা আমদানি করা হয়নি; বরং কক্সবাজার উপকূল থেকে অবৈধভাবে ধরা নিষিদ্ধ রেণু পোনা ‘বিদেশী’ বলে দেখিয়ে বিল প্রস্তুত করা হয়। মোনা মেরিন বায়োটেক নামে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের নকল ভাউচার ব্যবহার করে বিদেশ থেকে আমদানির গল্প সাজানো হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে কোনো পিপিএল পাঠায়নি এবং তাদের নামে করা ভাউচারও জাল। পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল প্রকল্প পরিচালক, তৎকালীন ডিজি এবং এমকেএ হ্যাচারির সমন্বয়ে সাজানো একটি পরিকল্পিত প্রতারণা। প্রায় দুই কোটি ৫৬ লাখ টাকা সরাসরি ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে সরানো হয় বলে অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, প্রকল্পে আউটসোর্সিং নিয়োগেও অনিয়ম ছিল মারাত্মক। ২০২০ সালে ২৬ জন স্পিডবোট চালক নিয়োগ দেয়া হয়, কিন্তু স্পিডবোট কেনা হয় ২০২৪ সালে। প্রায় আড়াই বছর প্রকল্পে কোনো স্পিডবোট না থাকলেও চালকদের নামে নিয়মিত বেতন তোলা হয়। প্রত্যেকের কাছ থেকে দেড় থেকে তিন লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ২৩টি নামসর্বস্ব ‘সাব প্রজেক্টের’ নামে ২৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, যার একটিও বাস্তবে নেই। এগুলো ব্যবহার করে চক্রটি সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেয়।
অনিয়ম বাদ যায়নি পরামর্শক নিয়োগেও। প্রায় ৬৫ জন পরামর্শকের নামে ২৮ কোটি টাকার বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। অনেকের নামই ভুয়া; আবার প্রকল্পের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এমন লোকের কাছেও কোটি টাকার বেশি পরিশোধের প্রমাণ মিলেছে। গাড়ি ভাড়ায়ও অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেছে, চীনের ১৬টি চেরি গাড়ি প্রতি মাসে দুই লাখ ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়া হয়, যা অন্য সরকারি প্রকল্পের তুলনায় প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা বেশি। বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, এখানেও পিডিসহ সংশ্লিষ্টরা কমিশন বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন এবং গাড়িগুলো প্রকল্পের কাজে ব্যবহার না হয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
অনিয়ম ধরা পড়েছে অডিট অধিদফতরের অডিটেও। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ২৫৮ কোটি টাকার গুরুতর আর্থিক অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে, বিএফডিসি ক্যাম্পাস তৈরিতে নিম্নমানের ডিফর্মড বার ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে ঠিকাদারকে ৪৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা প্রদান, খাল খননে অতিরিক্ত উচ্চতা দেখিয়ে ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা বিল উত্তোলন, অনুমোদন ছাড়া বিশেষজ্ঞ পরিবর্তন করে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় দেখানো, অসম্পন্ন কাজকে সম্পন্ন দেখিয়ে তিন কোটি টাকা বোনাস হিসেবে দেয়া এবং প্রয়োজনহীন পরামর্শক বরাদ্দে অতি ব্যয়। একই কাজের বিল দুবার তুলতে ৩৭ কোটি টাকার অসঙ্গতি ধরা পড়ে, ব্যাংক হিসাব বিবরণীতেও ৪৮ কোটি টাকার ভ্রান্তি পাওয়া যায়।
জানা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে মৎস্য অধিদফতর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রকল্পটি হাতে নেয়। লক্ষ্য ছিল উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, জেলে পরিবারদের আয়ের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু প্রকল্প শুরুর কিছুদিন পর থেকেই অতিরিক্ত ব্যয়, অনিয়মিত নিয়োগ, অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন দেখানো, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি এবং ঠিকাদার ও কর্তাদের যোগসাজশে অর্থ বণ্টনের অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ দেখিয়ে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বাদ দেয়া হয়। প্রকল্প পরিচালকও কয়েক দফা বদলানো হয়, কিন্তু অনিয়ম রোধ করা যায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার ছিল আলোচিত ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’র সমাপনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, গত ২৮ নভেম্বর বিশ্বব্যাংকের এ প্রকল্প শেষ হলেও আমাদের কাজ শেষ হবে না। কেননা এটি শেষ হওয়ার মতো কাজ না। আমাদের প্রকল্প চালিয়ে যেতে হবে। রেভিনিউ বাজেটের মাধ্যমে সরকারের দায়িত্ব হবে প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া। পরে হয়তো বিশ্বব্যাংক ফিরে আসবে। তিনি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মাছ আহরণের কারণে সমুদ্রে মাছের স্টক কমে আসছে। মাছ না পাওয়া যাওয়ার কারণে অনেকেই জাহাজ বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা ডিপ সিতে যেতে পারছি না। সমুদ্র উপকূলেও মাছ ধরাও কমেছে। এটি উদ্বেগের বিষয়। তাই উপকূল ও গভীর সমুদ্র নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মেরিন ফিশারিজের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এটিকে কাজে লাগাতে হবে।
রাজধানীর একটি তারকা হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আব্দুর রউফের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মোহাম্মদ জাবের, প্রকল্পের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক জিয়া হায়দার চৌধুরী।
ফরিদা আখতার বলেন, দেশে মাত্র চার শতাংশ নারী জেলেকে কার্ড দেয়া হয়েছে। এটা কম হলেও শুরু হয়েছে এটি ভালো দিক। তিনি বলেন, সমুদ্রে অনেক মাছের প্রজাতি আমরা নির্ণয় করতে পারিনি। ডিপ সি ফিসিং শুরু করতে পারিনি। আমাদের বেশকিছু জরিপ হয়েছে, যার মাধ্যমে মাছের স্টক সম্পর্কে জানা যাচ্ছে।
তিনি কপ-৩০ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, সমুদ্রে মাছ আহরণের ক্ষেত্রে ক্লাইমেট চেঞ্জ বড় ফেক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে কোস্টালে মেরিন ফিসারিজে অনেক প্রভাব পড়ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকেও মাথায় রাখতে হবে।
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে মৎস্য অধিদফতরের ডিজি ড. আব্দুর রউফ ও ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’র পিডি জিয়া হায়দারকে একাধিকবার ফোন দিলেও সাড়া দেননি।



