এখনো স্বৈরাচারের সহযোগীদের দখলে পরমাণু শক্তি কমিশন

নানামুখী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ

আমিনুল ইসলাম
Printed Edition

দেশের অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এখনো স্বৈরাচারের সহযোগীদের দখলে রয়েছে। আওয়ামী লীগের পলাতক নেত্রী শেখ হাসিনার ভাসুরের ছেলে ড. এ এফ এম মিজানুর এবং ড. দেবাশীষ পালসহ বঙ্গবন্ধু পরিষদের উচ্চপর্যায়ের নেতারা কলকাঠি নাড়ছেন। তাদের দৌরাত্ম্যে কোণঠাসা হয়ে আছেন দীর্ঘদিনের বৈশ্বম্যের শিকার নির্যাতিত বিজ্ঞানী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অভিযোগ রয়েছে, দেশের অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই কমিশনের উচ্চপর্যায়ে থাকা শেখ হাসিনার সহযোগীরা এখনো নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। নির্যাতিতরা বলছেন, যেখানে মন্ত্রণালয়ের সচিবই তালিকাভুক্ত স্বৈরাচারের দোসর, সেখানে স্বৈচারের দোসরের সহযোগী বিজ্ঞানী কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্র করবেন এটাই স্বাভাবিক।

জানা গেছে, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে ফ্যাসিস্টের বেশ কিছু দোসর গত ১৬ বছর বঙ্গবন্ধু পরমাণু বিজ্ঞানী পরিষদ নামে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কমিশনে নিয়োগ বাণিজ্য, প্রকল্পের মাধ্যমে লুটপাট, অবৈধ সুযোগ সুবিধা ভোগসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। তাদের এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড চালু রাখতে কমিশনের বিজ্ঞানীদের বৈধ সংগঠন ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি বিজ্ঞানী সংঘ, বায়েসা’র কার্যক্রম প্রায় ৮ বছর আটকে রাখা হয়। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পর কমিশনে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সেই দৌরাত্ম্য কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হলেও পরিষদের সেই কুশীলবেরা এখনো বহাল তবিয়তে কমিশনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

বর্তমানে কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. মো: কামরুল হুদা। তিনি গত ১৬ বছর কমিশনে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞানী পরিষদের সহযোগী ছিলেন। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ড. হুদার আশপাশে সেই ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের আনাগোনা বিরাজমান। নানাভাবে সে সময়ের সুবিধাভোগীরা এখনো কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রভাবিত করছেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছেন এবং চেয়ারম্যান প্রতিনিয়ত তাদের সুবিধা প্রদান করে চলেছেন।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু পরমাণু বিজ্ঞানী পরিষদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং পরিষদের সাবেক সদস্য পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ পালকে সম্প্রতি সদস্য (ভৌত বিজ্ঞান) পদে পদায়ন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদের কমিটির সদস্য ড. মো: খায়রুল ইসলামকে প্রধান কার্যালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভৌত বিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। একই সাথে তাকে অন্তত পাঁচটি কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। পরিষদের কর্মপরিষদ সদস্য ডা: ফজলুল বারীকে প্রদান করা হয়েছে নিনমাসের পরিচালক হিসেবে। ডা: বারী ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী হিসেবে ড. ওয়াজেদ মিয়া স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। অথচ তিনি আল্ট্রাসাউন্ড সংক্রান্ত ভুয়া সনদ বিক্রি এবং ট্যাক্স ফাঁকির দায়ে অভিযুক্ত। এ ছাড়াও তার নিয়োগ প্রক্রিয়াও বাপশক চাকরিবিধিমালা পরিপন্থী বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরিষদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এন কে মামুনকে সাভারের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আই এফ আর বি-র পরিচালক করা হয়েছে। পরিষদের বর্তমান সভাপতি টিস্যু ব্যাংকিংয়ের সাবেক পরিচালক ড. আসাদুজ্জামানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত চলমান এডিবি প্রকল্পটিতে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ থাকলেও অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। একইভাবে, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং পৃষ্ঠপোষক ফ্যাসিস্ট আমলের প্রায় ৮০০ কোটি টাকার চালমান প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মঞ্জুর আহসানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলমান এবং সম্প্রতি আদালত কর্তৃক দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও তিনি অদ্যাবধি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার ভাইয়ের ছেলে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এফ এম মিজানুর রহমান ছিলেন কমিশনে বঙ্গবন্ধু পরমাণু বিজ্ঞানী পরিষদ গঠনের প্রধান কারিগর। পরিষদের কার্যক্রম নির্বিঘœ করার স্বার্থে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিজ্ঞানীদের সংগঠন বায়েসা বন্ধ রাখার প্রধান কুশীলবও তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ার সুবাদে হয়েছিলেন প্রকল্প পরিচালক এবং পরবর্তীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক। তার পরিচালিত প্রকল্প নিয়েও দুর্নীতির নিরীক্ষা প্রতিবেদন রয়েছে। পরিষদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনরত ড. মিজানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে শুধুমাত্র রূপপুর প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক থেকে বাদ দিয়ে তাকে পূর্বতন বিভাগে পদায়ন করে মাসের পর মাস কোনো কাজ না করেই বেতন আহরণের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক ড. আখতারুজ্জামান, সিএসও, প্রধান কার্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত। যিনি আওয়ামী সরকারের আমলে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার একটি লুটপাট প্রকল্প দাখিল করেছিলেন যা সরকারের হটাৎ পতনে অনুমোদন লাভ করেনি। পরিষদের সাবেক সহসভাপতি এবং বর্তমান কোষাধ্যক্ষ প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক (সিই) এখনো প্রায় ৪০০ কোটি টাকা প্রকল্পের পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানা গেছে।

ফ্যাসিস্টের দোসরদের সুবিধা দিতে কমিশনের চেয়ারম্যানের দফতরে পদায়ন করা হয়েছে শেখ ফজলে নুর তাপসের আত্মীয় মনির সন্যামতকে! কোনো কার্যক্রম না থাকলেও বিগত কয়েক মাস ধরে চেয়ারম্যান দফতরে সংযুক্ত আছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের অন্যতম সমর্থক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর জামান চৌধুরী, যিনি বর্তমানে কোনো অফিসই করেন না। চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা মাসের পর মাস কোনো দায়িত্ব এবং অফিস ছাড়া বেতন আহরণ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও নিষিদ্ধ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসরদের অনেকেই বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের আওয়ামী আমলা ও কমিশনের চেয়ারম্যানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এখনো কমিশনে নিজ নিজ অবস্থানে বহাল রয়েছেন। ভুক্তভুগীরা বলছেন, নতুন বাংলাদেশ গঠন তথা বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে কমিশনকে ফ্যাসিস্ট মুক্ত করতে হবে।